জেলা প্রতিনিধি,রাজশাহীঃ
‘পানের বর (বরজ) আগুনে পুড়ে গেছে। এখন আমরা খাব কী করে, চলব কী করে, আর কিস্তি দেব কী করে। সপ্তায় তিন হাজার টাকা কিস্তি লাগে। ভ্যান চালিয়ে স্বামীর কিস্তির টাকা দেওয়া সম্ভব না। এখন কিস্তির টাকার চিন্তায় মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’রোববার (৫ মে) বিকেলে আগুনে পুড়ে যাওয়া পানের বরজের বাঁশগুলো সরানোর সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন আফরোজা বেগম।
এর আগে শুক্রবার (৩ মে) রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় গনিপুর ইউনিয়নের পোড়াকয়া গ্রামের ৫৩টি পানের বরজ পুড়ে ভস্মীভূত হয়। এতে নিঃস্ব হয়েছেন অন্তত ৮০ জন পানচাষি। এই নিঃস্ব পরিবারের মধ্যে রয়েছেন আফরোজা বেগম ছাড়াও মুনতাজ ও ইব্রাহীমেরা। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ১০০ বিঘা জমির পানের বরজ পুড়ে গেছে।
আফরোজা বেগম বলেন, পানগুলো বরজে রাখা হয়েছিল আসন্ন কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে। এই কারণে বেশ কিছুদিন থেকে বরজের পান তুলে হাটে বিক্রি করা হয়নি। আগুনে আমাদের পনের বরজ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোরবানি তো দূরে কথা। এখন আমরা খাব কী সেই চিন্তা করছি। আগে স্বামীর ভ্যান চালানো কাজের টাকা ও বরজের পান বিক্রি করা টাকায় আমাদের সংসার চলত।
তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে তিন হাজার টাকার কিস্তি লাগে। এখন তো ভ্যান চালিয়ে ৩ হাজার টাকা এই কিস্তি দেওয়া সম্ভব না। বরজে যে পান রেখে ছিলাম সেগুলো থাকলে হাটে বিক্রি করে চলতাম আর ভ্যানের ভাড়ার টাকা দিয়ে কিস্তি দেওয়া হতো। আমাদের পানের বরজের ওপরে নির্ভর করে ব্যাংক থেকে কিস্তির টাকা নেওয়া। পানের বরজ পুড়ে গেছে। এখন দিন চালানো আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে গেছে।’
বিকেলে নিজের জমিতে শ্রমিক দিয়ে পোড়া বাঁশগুলো জমিতে জড় করছিলেন অপর পানচাষি মুনতাজ হোসেন। তার দাবি, এই বাঁশ ও বাঁশের বাতাগুলো কোনো কাজে লাগবে না। তাই বের করে তিনি জমি পরিষ্কার করছেন।মুনতাজ হোসেন বলেন, ‘আমার ৯-১০ কাঠা জমির পানের বরজ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। কিছুই নেই। এখন পানের বরজ ঠিক করা অসম্ভব না। এখানে পুড়ে যাওয়া বাঁশ ও বাঁশের বাতাগুলো কোনো কাজে লাগবে না। এগুলো বাসায় লাকড়ি হিসেবে রান্নার কাজে লাগাতে হবে। এই আগুনে প্রায় চার লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বরজ থেকে পান বিক্রি করে আমার সংসার চলে। এখন সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হবে।’
পানচাষি ইব্রাহীম আলী বলেন, ‘এই পানের বরজ তৈরি করতে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন আমি কী করে খাব। আমার সংসার চালানোর মতো এতোটুকুই জমি। বাবার জমি ভাগে পেয়েছি মাত্র ৫ কাঠা। এই জমিতে পানের বরজ ছাড়া আমার অন্য কিছু নেই। কিন্তু সেই পানের বরজ চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কিস্তিতে দেড় লাখ টাকা ঋণ করা আছে। এই ঋণের টাকা দিয়ে পানের বরজ করা হয়েছিল। পান নেই বরজও নেই। এখন সারা বছর দেড় লাখ টাকার কিস্তি চালাতে হবে। এই কিস্তি কিভাবে চালাব। বুঝে উঠেতে পারছি না। এখন কিস্তিটাই বড় চিন্তা।’
এ বিষয়ে গনিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান রঞ্জু বলেন, তালিকা করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে এই পান চাষিদের উপকার হবে। গত বৃহস্পতিবারে উপজেলা কৃষি অফিসের সভায় কৃষকদের বার বার বলা হয়েছিল-কেউ যেন পানের বরজে বিড়ি, সিগারেট ও ম্যাচ না নিয়ে যায়। পানের বরজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমাতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিন ক্ষতিগ্রস্ত পানের বরজগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে কোনো সরকারি সহযোগিতা পেলে এই ক্ষতিগ্রস্থ চাষিদের মাঝে দেওয়া হবে।