পিলখানায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞের দিন আজ

১৫ বছর ধরে সাক্ষ্য গ্রহণে আটকে আছে বিস্ফোরক মামলার বিচার

প্রকাশিত: ৭:০১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪

# ৮৩৪ আসামির মধ্যে জীবিত ৭৯০, পলাতক ২০, মৃত ২৪
# ১২শ সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৭৩ জন
# হাইকোর্টে মৃত্যুদন্ডে ১৩৯, যাবজ্জীবন ১৮৫, খালাস ৪৫ জন
# চুড়ান্ড নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আপিল
# সুষ্ঠু বিচার ও দোষীদের মৃত্যুদন্ডে কার্যকরের দাবি স্বজনদের
# দিনব্যাপী নানান কর্মসূচি সেনাবাহিনী-বিজিবি’র

এসএম দেলোয়ার হোসেন
আজ ২৫ ফেব্রæয়ারি। ইতিহাসের সেই কালো দিন। পিলখানা সদর দপ্তরে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের দিন আজ। ১৫ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সাবেক বিডিআর ও বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তরের দরবার হলসহ পিলখানার ভেতর ঘটে ইতহাসের ভয়াবহ নৃশংসতার ঘটনা। কতিপয় বিপথগামী বিডিআর বিদ্রোহী জওয়ানরা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তৎকালীন বিডিআর বর্তমানে বিজিবি’র সদর দপ্তর পিলখানায় সেদিন বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা যে তান্ডবলীলা চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর কোনও বাহিনীর বিদ্রোহের ইতিহাসে নেই। নারকীয় ওই হত্যাকাÐের ঘটনায় দুটি মামলা হয়। একটি হত্যা মামলা অপরটি বিস্ফোরক আইনের মামলা। নিম্ন আদালত হত্যা মামলার রায় দেওয়ার পর হাইকোর্টে ১৩৯ জনকে মৃত্যুদন্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন ও ৪৫ জনকে খালাস দেন। কিন্তু এখনো মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়নি। রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আপিলের কারণে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। বিস্ফোরক মামলায় ১৫ বছরে ১২শ’ জনের মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৭৩ জন। সাক্ষগ্রহণের মধ্য দিয়েই আটকে রয়েছে এ মামলার বিচার কার্যক্রম। নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, আদালতে আসা যাওয়ার মধ্যেই বিচারপ্রার্থীরা ঘুরপাক খাচ্ছেন। আজো বিচার পাননি তারা। সুষ্ঠুভাবে মামলার বিচারকার্য নিষ্পত্তি করে দোষীদের মৃত্যুদন্ড দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা। এদিকে নির্মম এ ঘটনাকে শোকাবহ উল্লেখ করে আজ দিনব্যাপী নানান কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে সেনাবাহিনী-বিজিবিসহ নিহতদের স্বজনেরা।
জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। তখন সকাল ৯ টা ২৭ মিনিট। পিলখানা সদর দপ্তরের দরবার হলে চলমান বার্ষিক দরবারে একদল বিদ্রোহি বিডিআর সৈনিক ঢুকে পড়ে। সিপাহী মঈন নামে একজন বিডিআর সদস্য মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। বিডিআরের বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলে। পুরো পিলখানায় এক ভীতিকর বীভৎস ঘটনার সৃষ্টি করে। এ সময় তারা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিজিবি’র সদর দফতর পিলখানায় সেদিন বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা যে তান্ডব চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর কোনও বাহিনীর বিদ্রোহের ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
পিলখানায় নারকীয় হত্যার ঘটনায় দায়ের করা হয় দুটি মামলা। এর মধ্যে সেনা কর্মকর্তাদের নিহতের ঘটনায় দন্ডবিধি আইনে করা হয় হত্যা মামলা। অপরটি হয় বিস্ফোরক আইনে। বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলাটি ১৫ বছর ধরে সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্যে আটকে আছে। হত্যা মামলায় নি¤œ আদালত ২০১৪ সালে ১৫২ বিডিআর জওয়ানকে মৃত্যুদন্ড দেয়। যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয় ১৬১ জনকে। সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদন্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান আরো ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। ২০১৭ সালে হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জওয়ানকে মৃত্যুদন্ড দেয়। যাবজ্জীবন দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় আরো ২০০ জনকে। খালাস পান ৪৫ জন।
নিহতদের স্বজনরা আক্ষেপ করে বলেন, প্রতিবছর এই দিবসটি স্মরণ করতে এসে আমরা বনানীর সামরিক কবরস্থানে শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। আমাদের একটাই আক্ষেপ, ‘আমরা আর কি চাইবো? আজও হত্যার বিচার পেলাম না। এটাই চাইবো হত্যার বিচারটা অন্তত সুষ্ঠুভাবে হয়। আমাদের কারো মৃত্যুর আগে রায় শুনে যেতে পারলে তাতে আমারা শান্তি পেতাম। আজও একটি মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়নি। বিচারের রায় কার্যকর করা হলে অন্তত আত্মা শান্তি পাবে। অনেক স্বজনরা বলেন, পিলখানা হত্যাকান্ড যাদের ষড়যন্ত্রে সংঘটিত হয়েছে সেসব কুশীলব বা ষড়যন্ত্রকারীরা পর্দার আড়ালেই থেকে গেল। তারা কারা এখনও স্বজনরা তা জানতে পারেননি। আমরা চাই বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক।
এদিকে আদালত সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে এখনো বিচারাধীন রয়েছে পিলখানা হত্যাকান্ড দায়ের করা বিস্ফোরক আইনের মামলাটি। এই মামলায় আসামি রয়েছেন ৮৩৪ জন। এর মধ্যে একজন বেসামরিক ব্যক্তি, বাকি আসামিরা বিডিআরের জওয়ান। এই মামলায় আসামিদের মধ্যে ২৪ জন মারা গেছেন। জীবিত আসামী ৭৯০ জন। পলাতক রয়েছেন ২০ জন আসামি। পলাতকদের ধরিয়ে দিতে বিজিবি সারাদেশে ‘অপারেশন র‌্যাবল হান্ট’ নামে অভিযান চালিয়েও একজনকেও আটক করতে পারেনি। এই মামলায় এখন পর্যন্ত ২৭৩ জন সাক্ষী দিয়েছেন।
মামলার বিচার কার্যক্রম কবে নাগাদ সম্পন্ন হবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার পাবলিক প্রসিকিউশন (পিপি) মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রায় ১২ শত সাক্ষী রয়েছেন। সবার সাক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজন নেই। এই মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। মামলায় এখন পর্যন্ত ২৭৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এ বছরের মধ্যে আশা করছি আরো শ’দুয়েক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ নেয়া হবে। আসামিপক্ষ যদি সহায়তা করে, তাহলে এ বছরেই এই মামলার রায় দিতে পারবে আদালত।
আইনজীবীরা বলছেন, নৃশংস এই হত্যা মামলার হাইকোর্টের ৩০ হাজার পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি তুলতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টাকা। এখন আনুষঙ্গিক কাগজাদি (নিম্ন আদালতের রায়, সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা, আত্মপক্ষ সমর্থন) দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ আপিল করলে তার পৃষ্ঠাসংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৬৫ হাজারে। ফলে সব মিলিয়ে এক আপিল দায়েরে সম্ভাব্য খরচ পড়বে ১০ লাখ টাকার ওপরে। হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ে খালাস ও সাজা কম পাওয়া আসামিদের মৃত্যুদন্ড চেয়ে লিভ টু আপিল দায়ের করে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে, মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া প্রায় ৩শ আসামি খালাস চেয়ে আপিল বিভাগে আপিল করেছেন। রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের এসব আপিল এখন চুড়ান্ড নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। পরে এই আপিল দায়েরের বিষয়টি ব্যয় সাপেক্ষ হওয়ায় মেমো অব আপিলের মাধ্যমে আপিলের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করে আসামিপক্ষ। প্রধান বিচারপতি আসামিপক্ষের আবেদন মঞ্জুর করায় অন্যান্য আসামিদেরকে পূর্ণাঙ্গ পেপারবুক ছাড়াই আপিল দায়ের করার সুয়োগ হয়েছে। ফলে তাদের কাউকে ১০ লাখ টাকা থেকে ১২ লাখ টাকা ব্যয় করে আপিল দায়ের করতে হয়নি।
শোকাবহ দিবসের কর্মসূচি : পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাÐে শহীদ ব্যক্তিদের স্মরণে আজ রোববার শাহাদাতবার্ষিকী পালন করবে বিজিবি। দিনের কর্মসূচিতে রয়েছে, পিলখানাসহ বিজিবি’র সব রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর খতমে কোরআন, বিজিবির সব মসজিদে এবং বিওপি পর্যায়ে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় সকাল ৯টায় বনানীর সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ৩ বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একসঙ্গে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া দিবসটি পালন উপলক্ষে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর সকল স্থাপনায় বিজিবি পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং বিজিবি’র সকল সদস্য কালো ব্যাজ পরিধান করবে। পিলখানাস্থ বিজিবি কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাকা সেক্টর মসজিদ এবং বর্ডার গার্ড হাসপাতাল মসজিদে শহীদ ব্যক্তিবর্গের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।