পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চিকিৎসক সংকটে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা, বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়

রংপুর প্রতিনিধি:
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ চিকিৎসকসহ শতাধিক পদ শূন্য থাকায় চিকিৎসাসেবা প্রতিনিয়ত ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা অনেকেই বাধ্য হয়ে শহরমুখী হচ্ছেন। আবার কেউবা শহরে চিকিৎসা নিতে সামর্থ্যের হিসাব কষে একবুক হতাশা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন গ্রামে।
এদিকে চিকিৎসক যারা রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে ভুক্তভোগীদের নানা অভিযোগ। সরকারি বিধি মোতাবেক দায়িত্ব পালন না করাসহ নির্ধারিত সময়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপস্থিত না হওয়া এবং কখনো দুই-তিন ঘণ্টা অবস্থান করে চলে যাওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে রোগীদের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। দায়সারা দায়িত্বে কনসালটেন্টরাও একের পর এক ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন। যেন হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এসব দেখার কেউ নেই। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারি হাসপাতালের দিকে তাকিয়ে থাকা চিকিৎসা প্রত্যাশীরা।
পীরগঞ্জ সদরের মনোয়ারুল ইসলাম গত বুধবার (৫ মার্চ) দুপুরে বুকে ব্যথা নিয়ে যান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তিনি বলেন, হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি, হার্টের ডাক্তার নাকি দুই বছর ধরে হাসপাতালে নাই। রোজার মাসে কষ্ট করে এসে ডাক্তার না পেয়ে ফিরে যাচ্ছি।
এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক চিকিৎসক নাম না প্রকাশের শর্তে জানালেন, স্বাভাবিকভাবেই হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীর তুলনায় চিকিৎসক অনেক কম। এ কারণে রোগীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান ব্যাহত হচ্ছে
কর্তৃপক্ষ জানান, পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ২০১১ সালে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। আসবাবসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করা হয়েছে। তখন নিয়োগ দেওয়া হয় একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। অথচ বর্তমানে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ১১ জন।
এক সময় এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স জরুরি প্রসূতি সেবা (ইওসি) কার্যক্রমের আওতাভুক্ত হলেও এখন তা নেই। ফলে ঝুঁকি নিয়ে পীরগঞ্জ থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয় প্রসূতিদের।
এদিকে শুধু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই নাজুক দশা নয়, একই চিত্র উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রেও।
কাগজে-কলমে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসকের ১৬টি পদের বিপরীতে ১০ জন থাকলেও কর্মরত সাতজন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ জুনিয়র কনসালট্যান্ট মেডিসিন, গাইনি, শিশু, অর্থোপেডিক, কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞসহ ইএমও, আইএমও, এক সহকারী সার্জন ও দুইজন মেডিকেল অফিসার আছেন। তবে আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি), অ্যানেস্থেসিয়া, ফিজিক্যাল মেডিসিন, চক্ষু, ইএনটি এবং চর্ম ও যৌন বিশেষজ্ঞসহ এক সহকারী সার্জন, অ্যানেস্থেসিস্ট, এক মেডিকেল অফিসার, ডেন্টাল সার্জন, মেডিকেল অফিসার ইউনানিসহ চিকিৎসক নেই। এ ছাড়া ১৬টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৯টি মেডিকেল অফিসার পদে আছেন চারজন ও ৭টি সহকারী সার্জনের পদে আছেন তিনজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রতিটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক না থাকায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের ভিড় বাড়ছে।
আরএমও না থাকায় রায়পুর উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সহকারী সার্জন ডা. তারিকুল ইসলাম মন্ডলকে এখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, দায়িত্বরত আরএমওসহ চারজন ছাড়া বাকি সবাই রংপুর ও বগুড়া জেলা সদর থেকে যাতায়াত করেন। পদ শূন্য থাকায় ইউনিয়ন সেবাকেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। ৫৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকে ৫৪ জন সিএইচসিপি থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। তিনটি ওয়ার্ড বয়ের পদ থাকলেও আছেন দুইজন। পাঁচজন এমএলএসএসের স্থলে কর্মরত আছেন তিনজন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মাসুদ রানা বলেন, চিকিৎসক সংকটে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি সদ্য যোগদান করেছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের উপচে পড়া ভিড় দেখছেন প্রতিনিয়ত।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালটি ১০০ শয্যা করা জরুরি, মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারী ৫৫ পদের ৩৩টি শূন্য থাকায় রুটিন ইপিআই কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট মেডিকেল অফিসার ১০টি, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দুটি, ফার্মাসিস্ট দুটি, সহ-স্বাস্থ্য পরিদর্শক সাতটি, স্বাস্থ্য পরিদর্শক তিনটি, অফিস সহায়ক আটটি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী তিনটি, নিরাপত্তা প্রহরী দুটি, বাবুর্চি দুটি, আয়া একটি, জুনিয়র মেকানিকসহ ৯৮ জনের পদ শূন্য রয়েছে। গাইনি চিকিৎসক থাকলেও অ্যানেস্থেসিয়া না থাকায় সিজার করা যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি। তবে চিকিৎসকদের কর্মস্থলে না থাকার বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।