আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
দুই বছর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেনে আক্রমণের নির্দেশ দেন, তখনও তাকে দেখে মনে হতো, তিনি বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। আর এখন মনে হচ্ছে পরিস্থিতি তার অনুকূলে। এছাড়া ক্ষমতার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ারও কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে কিয়েভ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় রাশিয়ার সেনাবাহিনী। ২০২২ সালের শেষের দিকে খারকিভ ও খেরসন থেকেও পিছু হটতে বাধ্য হয় রুশ বাহিনী। কৃষ্ণ সাগরে রুশ জাহাজ ও লক্ষ্যবস্তুতে হামলা শুরু করে ইউক্রেন, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেখা যাচ্ছে, রাশিয়াকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞাগুলো হয়তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত মাসে ২০২৪ সালের জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে ২.৬ শতাংশ, যা আগের পূর্বাভাসের দ্বিগুণেরও বেশি।
এছাড়া ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়ায় আগামী ১৫ মার্চের নির্বাচনে আবারও ক্ষমতায় আসছেন পুতিন। তার কট্টর সমালোচক ও রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির মৃত্যু তাকে আরও শক্তিশালী করেছে। ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তা স্থগিত ও আভাদিভকার নিয়ন্ত্রণ তাকে আরও শক্তিশালী করেছে।
টেক্সাস ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রাল্ফ কার্টার নিউজউইককে বলেছেন, বিরোধী রাজনীতিবিদ আলেক্সি নাভালনি এবং ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগানার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের মৃত্যুর পর, রাষ্ট্রীয়ভাবে আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছেন পুতিন। আর এর মাধ্যমে আসলে পুতিন রুশদের এই বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছেন, যদি এই ঘটনা ওইসব নেতার সঙ্গে ঘটতে পারে, তবে তা আপনার সঙ্গেও ঘটতে পারে বলে জানিয়েছেন কার্টার।
নতুন বাজার, ট্রাম্প এবং কংগ্রেসের অচলাবস্থা
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপে পড়ে ইউরোপের বাজার থেকে ছিটকে পড়েন পুতিন। কিন্তু জ্বালানি রফতানির জন্য রাশিয়া ঠিকই চীন ও ভারতের মতো নতুন বাজার খুঁজে পেয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার চ্যাপম্যান ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক জন হল নিউজউইককে বলেছেন, যেহেতু ভারত রাশিয়ার তেল কিনতে রাজি হয়েছে, তাই রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা আসলে তেমন সফল হয়নি।
এদিকে, যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের জন্য ইউক্রেনের লোকবল আর যুদ্ধাস্ত্রের অভাব দেখা দিয়েছে। আর উত্তর কোরিয়া, ইরান ও চীন থেকে অস্ত্রের সরবরাহ নিশ্চিত করেছে রাশিয়া।
ইউক্রেনের জন্য আরও তহবিল দেওয়ার বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেসে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। এমন সময় ইউক্রেনকে সহায়তা না দেওয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের বক্তৃতা থেকেও উপকৃত হয়েছেন পুতিন।
প্রশ্নবিদ্ধ ন্যাটোর সংহতি
কলোরাডো স্কুল অব মাইনসের ইতিহাসের অধ্যাপক এবং মার্কিন-রাশিয়ার সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কেন ওসগুড বলেছেন, প্রতিরক্ষা খাতে ইইউভুক্ত দেশগুলোর ২ শতাংশ করে জমা দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ট্রাম্প আসলে ন্যাটোকে অপমান করেছেন। আর এই বিষয়টিও পুতিনের পক্ষেই গেছে।
তিনি নিউজউইককে বলেন, জোসেফ স্টালিনের পর থেকে প্রত্যেক রুশ নেতার লক্ষ্য ছিল ন্যাটোর সংহতি ভাঙা। ট্রাম্প যদি পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন বা নির্বাচনে হেরে গেলেও, ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের বিষয়টির কথা ভাবাচ্ছে মার্কিনিদের।
শীর্ষ সামরিক নেতাদের সঙ্গে পুতিন। ফাইল ছবি: রয়টার্স
শীর্ষ সামরিক নেতাদের সঙ্গে পুতিন। ফাইল ছবি: রয়টার্স
দীর্ঘমেয়াদে কী আছে?
ফ্র্যাঙ্কলিন অ্যান্ড মার্শাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক জেনিফার কিবে নিউজউইককে বলেছেন, নানা কারণেই বর্তমানে ইউক্রেনে আসলেই পুতিন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু আসলেই কী তাই?
কিন্তু গত জুনে প্রিগোজিনের বিদ্রোহের দ্রুততা দেখিয়ে দিয়েছিল যে পুতিনের রাশিয়ায় পরিস্থিতি কত দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে।
সিবিএস নিউজের সাবেক মস্কো ব্যুরো চিফ বেথ নোবেল বলেছেন, রুশরা যুদ্ধের বিষয়ে সতর্ক হয়ে উঠছে। কারণ রাশিয়ার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক মনে করেন, পুতিন বরং এখন দুই বছর আগের তুলনায় দুর্বল অবস্থানে রয়েছেন। কারণ নাভালনিকে প্রকাশ্যে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া অনেককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর কারণ, পুতিন আসলে বিপ্লবকে ভয় পান। তিনি সম্ভবত বিক্ষোভকেও ভয় পান।
রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কালনি সেন্টার ফর পোলিশ অ্যান্ড সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান স্টাডিজের পরিচালক র্যানডাল স্টোন বলেছেন, পুতিন খুবই অনিরাপদ। ওয়াগনার বাহিনীর বিদ্রোহ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ক্ষমতার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ কতটা ক্ষীণ।
রুশ বংশোদ্ভূত অর্থনীতিবিদ কনস্ট্যান্টিন সোনিন, বর্তমানে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেছেন, নাভালনির মৃত্যু স্বল্পমেয়াদে পুতিনের জন্য একটি বিশাল জয়। তবে এর মাধ্যমে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে কোণঠাসা করে ফেলেছেন তিনি।
নিউজউইককে তিনি বলেন, পুতিনের পক্ষে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার কোনও পথ নেই। পুতিন যুদ্ধ থামাতে পারবেন না। দমন-পীড়নও বন্ধ করতে পারবেন না। তিনি এমনভাবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যাচ্ছেন যে মনে হচ্ছে এটি তাকে পতনের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র: নিউজউইক