প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনায় যেভাবে গড়ে উঠবে ‘সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনা’
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে সংশ্লিষ্টরা
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
সেলিনা আক্তার :
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে এগোচ্ছে সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য যতগুলো খাত আছে, সবাই একত্র হয়ে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে সংশ্লিষ্টরা। নতুন সরকারের প্রথম কেবিনেট সভায় প্রধানমন্ত্রী এমন নির্দেশনা দিয়েছেন। বিষয়টি বাস্তবায়নে একযোগে কাজ শুরু করছে কয়েকটি মন্ত্রণালয়।
চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সবাইকে অবদান রাখা, সবার ভূমিকা থাকা ও উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার, ‘দেশের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং যাতে সহজলভ্য হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা’। বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনের কারসাজিতে কিছু জিনিসের দামের ব্যত্যয় ঘটেছে; সেটা যাতে আর না ঘটে, সে ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা আলোচনা করতেই আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে মোতাবেক কাজও শুরু হয়ে গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, অত্যাবশ্যকীয় আটটি নিত্যপণ্য আমদানিতে এরই মধ্যে মার্জিন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রয়োজনে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে আরও নির্দেশনা দেওয়া হবে। রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে, সেসব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। চিন্তার কোনও কারণ নেই। এরপরও কিছু মজুতদার চেষ্টা করে কীভাবে বাজার অস্থিতিশীল করা যায়।
বাজার অর্থনীতিতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটবেই। কেউ কেউ হয়তো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক রয়েছে। যেভাবে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখা যায়, ঠিক সে কাজগুলোই সরকার করছে বলে জানিয়েছে ওই সূত্র।
আরও জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এ মুহূর্তে চিনিসহ যেসব পণ্যের দাম বেশি রয়েছে, সেগুলোর আমদানি শুল্ক নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রয়োজনে এসব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে দাম সহনীয় রাখার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া ডলার ছাড়া ভারত ও চীনের মুদ্রায় পণ্য আমদানির সুযোগ রয়েছে সরকারের হাতে। এসব পদ্ধতিতে পণ্য আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীরা যাতে কোনও ধরনের জটিলতায় না পড়েন, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনিটরিং কার্যক্রম বাড়াবে। এভাবেই গড়ে উঠবে সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনা।
আন্তমন্ত্রণালয় সভার বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে যার যেখানে ভূমিকা রয়েছে, সেখান থেকেই অবদান রাখতে হবে, ভূমিকা থাকতে হবে, উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই গড়ে তোলা যাবে সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনা, এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণেই এখন থেকে কোনও একক মন্ত্রণালয় নয়, বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেবে আন্তমন্ত্রণালয় এবং সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে তারা।
সভা সূত্র জানায়, শুধু নিয়ন্ত্রণই নয়, বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতেও কাজ করবে আন্তমন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে বাজার-সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বাইরেও অপরাপর যেকোনও মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেওয়া হবে। সরকার মনে করে, মানুষের বুকে চাকু মেরে অধিক মুনাফা আর নয়। এ ক্ষেত্রে বাজার বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেওয়া হবে।
আন্তমন্ত্রণালয় সভায় যে চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো— এক. আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব পণ্যের দাম বেশি, সেগুলোর শুল্ক কমানোর সুপারিশ করা, দুই. ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় ডলার সহায়তা দেওয়া, তিন. ডলারের সংকট হলে বিকল্প মুদ্রায় পণ্য আমদানির উদ্যোগ নেওয়া এবং চার. দেশে উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে দাম সহনীয় রাখার পাশাপাশি মজুতদারি করে কোনও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বা বাজার অস্থিতিশীল করার উদ্যোগ নেওয়া হলে তা কঠোরভাবে দমন করা।
গত ২১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সরকার মনে করে, বাজারে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী ও কিছু মতলববাজ আছে, যারা কারসাজি করে। এই শ্রেণির কৃত্রিম সংকটের কারণে নিত্যপণ্য নিয়ে বিপদে পড়ে সরকার।
জনসাধারণকে আশ্বস্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে কয়েকজন মন্ত্রী বলেছেন, যেসব মেজার্স আমরা কঠিনভাবে নেবো, ইনশা আল্লাহ শিগগির আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।
আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে কোনও ব্যবসায়ী কারসাজি করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। লাইসেন্স বাতিল করা হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ছাড়পত্র বন্ধ করা হবে। কারণ কারা বাজার ম্যানুপুলেট করছে, তাদের শনাক্ত করা গেছে। তবে সেটা পূর্ণাঙ্গ বের করার ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ। এ নিয়ে আলোচনা চলছে। যখন সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যাবে, তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, রমজান আসছে। আমরা আন্তমন্ত্রণালয় সভা করে সর্বশেষ পরিস্থিতি জেনেছি। এই মুহূর্তে দেশের কোথাও কোনও পণ্যের ঘাটতি নেই। রজমান মাসে যেসব পণ্য লাগে, তা নিয়ে চিন্তার কোনও কারণ নেই। কিছু মহল চেষ্টা করে কীভাবে সিচুয়েশনকে ডিস্টাবলাইজ করা যায়। যেখানে মার্কেট ইকোনমি অপারেট করছে, সেখানে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা হয়তো করবে, কিন্তু আমরা তৎপর রয়েছি। সে সুযোগ তারা পাবে না।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, যেভাবে প্রাইস লেভেলকে ধরে রাখা যায়, সে কাজগুলো করছে সরকার। প্রয়োজন হলে আমরা অনেক কঠোর পদক্ষেপের দিকে যাবো। দরকার হলে শাস্তিমূলক পদক্ষেপের দিকে যাবো, কাউকে ছাড় দেবো না। এখনও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি বলেও জানান তিনি।
জরুরি বৈঠকের কারণ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, রমজান মাস নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে মানুষের মধ্যে। সে কারণে এ মাস অগ্রাধিকার পেয়েছে। সরকার পুরো বছরের জন্যই পরিকল্পনা করছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়েই আমরা বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে চাই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার জানিয়েছেন, রমজানের পণ্য আমদানি গত বছর জুলাই থেকে জানুয়ারির তুলনায় এ বছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি এলসি খোলা হয়েছে। ফলে এলসি খোলার সমস্যার কথা বলা হলেও সেটি সঠিক নয়। এ পণ্যগুলো সময়মতো দেশে এসে পৌঁছাবে। কোনও মধ্যস্বত্বভোগী সমস্যা সৃষ্টি না করলে মূল্যবৃদ্ধির কোনও কারণ নেই, পণ্যেরও কোনও সংকট নেই। এলসি খোলায় সমস্যা সম্পর্কিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্প্রতি দেওয়া চিঠিটি রুটিন চিঠি বলে জানিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে বসাটা সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। শেখ হাসিনা সরকারের একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার, দেশের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং যাতে সহজলভ্য হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সুতরাং আপনারা আজ থেকে আশ্বস্ত হতে পারেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা কঠিনভাবে পদক্ষেপ নেবো। ইনশা আল্লাহ আমরা শিগগির লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।
বাজার ম্যানুপুলেট সম্পর্কে আব্দুর রহমান বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি। ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ। চিহ্নিতকরণ যখন সুনির্দিষ্ট করা যাবে, তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে, লাইসেন্স বাতিল করা হবে, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ছাড়পত্র বন্ধ করা হবে।