মোঃ সাইফুল ইসলামঃ
ডিজিটাল যুগে ভাটা পড়েছে ঐতিহ্যের হালখাতায়। চারপাশে প্রযুক্তির ছোঁয়া, কম্পিউটার, ল্যাপটপ আর অ্যাপসের দুনিয়ায় হাতে লেখা খাতার প্রচলন প্রায় উঠে যেতে বসেছে। ফলে এখন আর বাংলা সনের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীদের নতুন টালিখাতা খুলতে খুব একটা দেখা যায় না। তবে ঐতিহ্য রক্ষায় এখনো রাজধানীর অনেক ব্যবসায়ী রীতি ধরে রাখতে হালখাতা উৎসব করে থাকেন। এই হালখাতার উৎসব হয় মূলত, বৈশাখ মাসের প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে। এদিন ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে পুরোনো বছরের লেনদেন চুকিয়ে, নতুন বছরে খোলা হয় হিসাবের নতুন খাতা। এই খাতাকেই বলে ‘হাল নাগাদ খাতা’ বা ‘হালখাতা’।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ থেকে ১১ মার্চ মোগল সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর তত্কালীন ভারতবর্ষে ‘হালখাতার’ প্রচলন শুরু হয়। মূলত হালখাতা উৎসব উদযাপন করা হতো রাজাদের খাজনা প্রদানের ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানের রীতি ধরে। কালের পরিক্রমায় ‘পুণ্যাহ’ উৎসব হারিয়ে গেলেও হালখাতা চলছে এখন পর্যন্ত। তখন বাঙালি মুসলমানরা খাতার প্রথম পাতায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বা ‘এলাহি ভরসা’ লিখতেন। ‘হাল’ শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ফারসি শব্দ ‘হাল’ এর অর্থ ‘নতুন’।
রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার ও শাঁখারী বাজার, শ্যামবাজার ঘুরে জানা যায়, এ বছর ঈদের ছুটির কারণে সীমিত পরিসরে হালখাতার আয়োজন করেছিলেন কিছু ব্যবসায়ী। তারা জানান, হালখাতা আমাদের আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি। বছরের প্রথম সকালে দোকান সোনা-রুপার পানি ও গোলাপজল ছিটিয়ে, অনেকে ধূপের ধোঁয়া দিয়ে হালখাতার পর্ব শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। এদিন পুরোনো খাতার হিসাব শেষ করে খোলা হয় নতুন খাতা।
তবে সময়ের সঙ্গে হালখাতা উৎসব এখন অনেকটাই মলিন। রাজধানীর তাঁতীবাজার ও শাঁখারী বাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ঐতিহ্য ধরে রাখতেই স্বল্প পরিসরে করে থাকেন ‘হালখাতা’। ব্যবসায়ী শাহীন মিয়া বলেন, আমাদের পূর্ব-পুরুষদের ঐতিহ্য এই ব্যবসা ও হালখাতা, সেই ধারাবাহিকতা রক্ষায় এখনো আমরা হালখাতা করে আসছি। তবে এ বছর ঈদের ছুটির কারণে হালখাতা হয়েছে সীমিত পরিসরে। তিনি বলেন, ঈদের ছুটিতে অনেক ক্রেতা গ্রামের বাড়ি গেছেন, ফলে হালখাতায় তারা আসতেও পারেননি।
পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, শাঁখারীবাজার, বাংলাবাজার ও ইসলামপুরের ব্যবসায়ীরা জানান, জাঁকজমকের সঙ্গে হালখাতা উদযাপন না করলেও বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন থেকে লালসালু মোড়ানো খাতায় হিসাব শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। অন্য এক জন ব্যবসায়ী রানা মিয়া বলেন, একসময় মানুষের হাতে নগদ অর্থ কম ছিল। তখন মানুষ বাকিতে অনেকে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতেন, আর সেই বাকির টাকা তুলতে হালখাতা হতো। সেই জায়গায় পরিবর্তন এসেছে, এখন মানুষের হাতে টাকা না থাকলেও বিকল্প ব্যাংক কার্ড থাকে, ফোন ব্যাংকিং হয়, ফলে এখন আর আগের মতো বাকিও পড়ে না। আর পড়লেও বিকাশ-নগদ কিংবা কার্ডে সেই বিল পরিশোধ হয়। এজন্য দোকানেও ক্রেতাদের আসতে হয় না। ফলে হালখাতার তেমন উপযোগিতা নেই।
হালখাতায় কী হয়: বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে নতুন হিসাবের খাতা খোলেন। একসময় হালখাতার আয়োজন হতো ‘কার্ড’ ছাপানোর মাধ্যমে। ‘শুভ হালখাতা কার্ড’-এর মাধ্যমে ক্রেতাদের দোকানে আসার নিমন্ত্রণ জানানো হতো। ঐ দিন ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করানো হতো। ক্রেতারাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরোনো দেনা শোধ করে দিতেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় সারা বছরের হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতার হিসাব শেষ করে বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো নতুন খাতা। ঐ খাতা লাল কাপড়ে মোড়ানো বা বাঁধাই করানো থাকে। একসময় ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতো এই খাতা। তবে এ সময়ের ডিজিটাল হিসাব-নিকাশের যন্ত্রগুলো দখল করে নিয়েছে টালিখাতার জায়গা। তারপরও অনেক ব্যবসায়ী সকালবেলায় সংগ্রহ করেন লালসালুতে মোড়ানো টালিখাতা। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন জেলায় এখনো এই রেওয়াজ পালন হয়ে থাকে।
তবে যুগের পরিবর্তনে পালটে গেছে বেচাকেনা আর লেনদেনের মাধ্যম। ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করেন। হিসাব-নিকাশের জন্য বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে যুক্ত হয়েছে কম্পিউটার ও বিশেষায়িত সফটওয়্যার। কার্ড বা চিঠির মাধ্যমে এখন আর বকেয়া হিসাব স্মরণ করিয়ে দিতে হয় না। সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে ইমেইল ও মোবাইল। অনেকেই এখন কার্ডে কেনাকাটা করেন, বকেয়া পরিশোধ করেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। ফলে কার্ড ছেপে দাওয়াত কিংবা টালি খাতা কিনে হিসাব-নিকাশ করার কোনো তোড়জোড়ও নেই।