ফরিদপুরের সেই ঘটনায় শ্রমিকরা আগুন দেননি : তদন্ত কমিটি
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
জেলা প্রতিনিধি,ফরিদপুরঃ
গত ১৮ এপ্রিল রাতে ফরিদপুরের মধুখালীর পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত একটি মন্দিরে প্রতিমার গায়ের কাপড়ে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। আগুন দেওয়ার সন্দেহে দুই সহোদর মুসলিম নির্মাণশ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে মন্দিরের প্রতিমার শাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলা হলেও কারা সে আগুন দিয়েছে তা উদ্ঘাটন করা যায়নি বলে মন্তব্য করা হয়েছে। পাশাপাশি শ্রমিকরা এ কাজ করেননি বলে তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহ্ আসাদুজ্জামান, ইউপি সদস্য (মেম্বার) অজিত বিশ্বাস ও অমৃত কুমার বসু নামে এক গ্রাম পুলিশের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বেঁধে নির্যাতন করার সত্যতা পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশ মারধর শুরু করায় গ্রামবাসী শ্রমিকদের ওপর আক্রোশে ফেটে পড়েন।এ জাতীয় ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্দিরে প্রতিমার শাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তবে এ ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। আগুন নেভাতে গ্রামবাসীর সঙ্গে পঞ্চপল্লি সার্বজনীন কালী মন্দির সংলগ্ন পঞ্চপল্লি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়াশ ব্লক নির্মাণে নিয়োজিত শ্রমিকরাও বালতি হাতে অংশ নেন। তবে ওই এলাকাটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত হওয়ায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় গ্রামবাসী নির্মাণ শ্রমিকদের সন্দেহ করে। এ সন্দেহ থেকে গ্রামবাসী তাদের বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে নিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। খবর পেয়ে ডুমাইন ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশ ঘটনাস্থলে আসেন। তারা শ্রমিকদের এ আগুন লাগানোর জন্য দায়ী করে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেন। এ সময় ওই দুই জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশ শ্রমিকদের কিল-ঘুসি ও চড়থাপ্পড় মারেন।
নির্বাচিত দুই জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশের এ আচরণ উসকানি হিসেবে কাজ করে। এতে গ্রমাবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তবে ওই কক্ষে ওই শ্রমিকরা ছাড়া ইউপি চেয়ারম্যান, গ্রাম পুলিশ ও স্থানীয় তিন শিক্ষক লক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রভাষ কুমার বিশ্বাস, ডুমাইন শহীদ মফিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তম কুমার বিশ্বাস ও পঞ্চপল্লি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসসহ ৮-১০ জনের বেশি লোক ছিল। গ্রামবাসী কক্ষের বাইরে অবস্থান করে ইট ছুড়তে থাকে ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
ঘটনাটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান পুলিশকে খবর দেন। ঘটনার পর ওই ইউপি চেয়ারম্যানই জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সকলের পাশে থেকে আহত শ্রমিকদের উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করেন। পরবর্তীতে তদন্ত কাজেও সহায়তা করেন। তবে এ ঘটনার তিনটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় দুই জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশের কর্মকাণ্ড ফাঁস হয়ে যায়। এরপর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য আত্মগোপন করেন এবং গ্রাম পুলিশকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী বলেন, মূলত ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য ওই শ্রমিকদের মারধর শুরু করায় স্থানীয়রা উৎসাহ পেয়ে যান। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।তিনি বলেন, এ ঘটনায় চাঁদাবাজি কিংবা ইভটিজিং বা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার সংক্রান্ত কোনো অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশ দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখলে এ ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল। তাদের উচিত ছিল শ্রমিকদের মধুখালী থানায় বা ইউপি ভবনে নিয়ে যাওয়া।
তদন্ত কমিটি এ ঘটনার জন্য ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মধুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ্ আসাদুজ্জামান এবং ইউপি সদস্য অজিত বিশ্বাস ও গ্রাম পুলিশ অমৃত কুমার বসুকে দায়ী করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্দির ও স্কুলটি আনুমানিক ৫০ গজের মধ্যে পাশাপাশি অবস্থিত। গত এক মাস ধরে নির্মাণ শ্রমিকরা স্কুলে কাজ করছিলেন। মন্দিরটি ছিল অরক্ষিত। ওই এলাকার পাঁচটি গ্রামে অন্য সম্প্রদায়ের কোনো লোক বসবাস করেন না। ওই দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রতিমার শাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এর ১৫ মিনিট পর নসিমনে করে নির্মাণ কাজের রড আনা হয়। ওই সময় ঘটনাস্থলে অল্প কয়েকজন লোক উপস্থিত ছিলেন। নসিমনের দড়ি দিয়ে শ্রমিকদের বাঁধা হয়। নসিমন চালক লিটন শেখকে গ্রাম পুলিশ প্রথমে চড়থাপ্পড় মারেন। পরে ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য শ্রমিকদের চড়থাপ্পড় মারা শুরু করেন এবং প্রতিমায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেন।
তদন্ত কমিটি আগামীতে এ জাতীয় ঘটনা এড়ানোর জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রত্যেক মন্দির ও বিদ্যালয় সি সি ক্যামেরার আওতায় আনা। মসজিদ মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য উঁচু প্রাচীর দেওয়া। তাৎক্ষণিকভাবে এ জাতীয় ঘটনা কীভাবে মোকাবিলা করা যায় এ জন্য জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যে এলাকায় একই ধর্মের লোক বেশি বসবাস করেন সে এলাকায় অন্য ধর্মের কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ কাজ করতে গেলে আগে থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে জানিয়ে রাখা। ধর্মীয় সম্প্রতি বজায় রাখতে প্রতিনিয়ত প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া।
গত ১৮ এপ্রিল সংঘটিত ঘটনায় জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিকে তিন কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এ কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন, সহকারী পুলিশ সুপার (মধাখালী সার্কেল) মিজানুর রহমান এবং মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. ইউসুফ আলী।
১৯ এপ্রিল থেকে এ কমিটি কাজ শুরু করলেও তিন দিনে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে পারেনি। পরে দুই দফা সময় বাড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার (৯ মে) জেলা প্রশাসকের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, মন্দিরের প্রতিমার শাড়িতে কীভাবে আগুন ধরল তা নিশ্চিত হতে পারেনি তদন্ত কমিটি। তবে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল তা আমাদের কাছে এখন অনেকটাই পরিষ্কার। সেই অনুযায়ী আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ আমরা নিচ্ছি এবং এ ঘটনায় আইন অনুযায়ী বিচার হবে। কারও ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
মামলার সর্বশেষ অবস্থা- হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা ও প্রতিমার কাপড়ে আগুন দেওয়ার ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। পুলিশ জানায়, এ পর্যন্ত পুলিশের ওপর হামলার মামলায় ৩১ জন ও হত্যা মামলায় ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের ওপর হামলার মামলায় এ পর্যন্ত ৪ জন এবং হত্যা মামলায় ৭ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান ও ইউপি সদস্য অজিত বিশ্বাস পালিয়ে আছেন। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।