নিজস্ব প্রতিবেদক:
স্লোগান বদলে গেছে। এসেছে নতুন মুখ। নতুন পরিপ্রেক্ষিত। নতুনের কেতন উড়িয়ে, মৃত্যুকে অতি তুচ্ছ জ্ঞান করে অসমসাহসিকতায় তরুণ প্রজন্ম দমকা হাওয়ার মতো ছুটে এসে উড়িয়ে দিয়েছে স্বৈরশাসনের ভিত। তারা দেয়ালে লিখেছে ‘৭১-এ দেশ লাভ, ২৪-এ পূর্ণ স্বাধীনতা’। এই তারুণ্যের শক্তি সাহস বীরত্বের প্রতীক হয়ে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ালেন আবু সাঈদ। অম্লান হাসিমুখের মুগ্ধ মমতা ছড়িয়ে গেলেন প্রাণ থেকে প্রাণে। তাঁদের মতো অগণিত তাজা তরুণের আত্মদানের ভেতর দিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘটনা জাতির আন্দোলন–সংগ্রামের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজিত করেছে।
শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের অভীপ্সা দেশের মনন ও সৃজনশীল কাজে, সংস্কৃতিতে, প্রকাশনায় তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের ছাপ রেখেছে। শহরের দেয়ালে দেয়ালে তরুণ শিক্ষার্থীরা গ্রাফিতি এঁকে সমাজসংস্কার ও নতুন চিন্তাচেতনার কথা তুলে ধরেছেন, কার্টুন এঁকেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের সময়ের ছবির প্রদর্শনী করেছেন। পরে সেসব নিয়ে প্রকাশিত হয় একাধিক বই। এগুলোর মধ্যে কিছু ছিল প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনা আর কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
‘আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ ও অন্যান্য প্রকাশনা
প্রকাশনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো আর্ট অব ট্রায়াম্ফ। গণ-অভ্যুত্থানের অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে গ্রাফিতিগুলো আঁকা হয়েছে শহরের দেয়ালে দেয়ালে, তার কিছু নির্বাচিত গ্রাফিতি নিয়ে এই ছবির বই। এতে অর্ধশতাধিক গ্রাফিতির ছবি রয়েছে। সেখানে আছে বাঘের প্রতিকৃতির আদলে লাল-সবুজ পতাকার প্রেক্ষাপটে বীর আবু সাঈদের প্রতিকৃতি, এক পাশে শহীদের মৃতদেহ কোলে নিয়ে পথে নামা স্বজন, অন্য পাশে প্রতিবাদী মিছিল। এই গ্রাফিতির নাম ‘রক্তাক্ত জুলাই’। বইটির প্রচ্ছদেও এই দৃশ্য ব্যবহার করা হয়েছে। বইটিতে আরও আছে ‘পানি লাগবে পানি’ বলে পথে নামা মুগ্ধর মুখ আঁকা গ্রাফিতি, হাত ধরাধরি করে বসে থাকা সাদা–কালো রঙে আঁকা দুই নারীর ছবিতে লেখা ‘বর্ণবাদ অগ্রহণযোগ্য’, দেয়ালে লেখা স্লোগান ‘নতুন কিছু করাই তরুণের ধর্ম’। কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন এবারের আন্দোলনে অন্যতম অনুপ্রেরণার উৎস। ‘কে দেয় সাজা মুক্ত স্বাধীন সত্য কে রে’,‘মোর বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন চিত্ত মুক্ত শতদল’ এমন অনেক পঙ্ক্তির সঙ্গে শিকলছেঁড়া বজ্রমুষ্টির ছবি এসেছে দেয়ালে দেয়ালে। অনেক ছবি আছে প্রতীক আকারে, যেমন আকাশে উড়ছে ঘুড়ি মুক্তির প্রতীক হয়ে। আছে স্বৈরশাসক হিসেবে চিহ্নিত করে, শেখ হাসিনার বহু রকমের প্রতিকৃতি ইত্যাদি।
প্রকাশনাটি সম্পর্কে মূল উদ্যোক্তা মো. আনিস উজ জামান বলেন, অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি সম্পর্কে খুব আগ্রহী ছিলেন। তাঁর আগ্রহের কারণেই আমরা গ্রাফিতিগুলোর আলোকচিত্র সংগ্রহ করি। সেখান থেকে বাছাই করা ৫৬টি গ্রাফিতির আলোকচিত্র নিয়ে বইটি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে ভাষণ দিতে যাওয়ার সময় যেন সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন, সে জন্য এটি দ্রুত প্রকাশ করা হয়েছিল। তিনি জানান, এখন এটি ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’কে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই বইয়ের সঙ্গে আরও ছবি নিয়ে বড় আকারে পরবর্তী সংস্করণ প্রকাশের কাজ করছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। জানুয়ারিতে এর আনুষ্ঠানিক প্রকাশনার পরিকল্পনা রয়েছে। এই ছবির বইটির প্রকাশনার দলে আরও ছিলেন তওফিক বারী, তাজরিনা মান্নান সিরাজ ও সায়েন সিরাজ। আলোকচিত্র তুলেছেন মোরশেদ মিশু ও অভিজিৎ কর্মকার।
প্রাতিষ্ঠানিক আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা জুলাই আপরাইজিং: স্যাটায়ার অ্যান্ড রিডিকুল এটি কার্টুন নিয়ে প্রায় ২০০ পাতার বই। যৌথভাবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, দৃক পিকচার লাইব্রেরি লি. ও ইয়ারকি। সম্পাদনা করেছেন শহিদুল আলম। এই বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, শেখ হাসিনার স্বৈরাচার হয়ে ওঠা, ছাত্রদের কোটা সংস্কার নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, সরকারি দমন–পীড়ন ও জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে স্বৈরশাসকের পতন পর্যন্ত মোট আটটি পর্বের ঘটনা কার্টুনে তুলে ধরেছেন তরুণ কার্টুনিস্টরা।
সমাজবাস্তবতার ঘটনাপ্রবাহ ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে কার্টুনের আকারে প্রকাশ করা মতপ্রকাশ তথা ভিন্নমাত্রার শিল্পচর্চার এক প্রসিদ্ধ রীতি। কিন্তু বিগত দেড় দশকে শাসকশ্রেণি তাদের সমালোচনামূলক কার্টুন সুনজরে দেখেনি। সরকারের পতনের পরে কার্টুনিস্টরা মুক্ত পরিবেশে নতুন উদ্যমে কার্টুন এঁকে বিগত কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের দমন–পীড়ন, দুর্নীতি, বলপ্রয়োগ, জেল–জুলুমের বিষয়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। দৃক গ্যালারিতে আগস্ট মাসে তিন শর বেশি কার্টুন নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রদর্শনী। সেখান থেকে বাছাই করা কার্টুন নিয়ে করা হয়েছে এই প্রকাশনা।
গণমাধ্যমগুলোতে অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছে আলোকচিত্র ও ভিডিও। প্রথম আলোতে আলোকচিত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিক্ষুব্ধ রাজপথ থেকে তুলে এনেছেন প্রতিবাদ, বিক্ষোভ আর সরকারি হুকুমে পুলিশ-র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর গোলাগুলির দৃশ্য। বাছাই করা ৮৭টি ছবি নিয়ে প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়েছে মুক্ত করো ভয় নামে ‘জুলাই-আগস্ট ২০২৪’ ফটো জার্নাল।
এবার প্রথম আলোর বর্ষপূর্তির কর্মসূচির কেন্দ্রীয় ভাবনা ছিল ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান। ‘জেগেছে বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রকাশিত এই ফটো জার্নালে দেখা যাবে ছাত্রমিছিলে গুলি, রাজপথে পড়ে থাকা লাশ, গ্রেপ্তার, অগ্নিকাণ্ড, আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে স্বৈরশাসকের পতন, জনতার বিজয় মিছিলসহ বিভিন্ন দৃশ্য। প্রকাশনাটিতে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে আলোকচিত্রের সঙ্গে সেই সময়ের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বেশ কিছু গ্রাফিক, চিত্রকর্ম ও গ্রাফিতির সংযোজন। এর প্রচ্ছদে রয়েছে বীর আবু সাঈদের দুই হাত প্রসারিত ছবিটি।
আলোকচিত্রীরা হলেন মোহাম্মদ খালেদ সরকার, কবির হোসেন, মোহাম্মদ জাহিদুল করিম, আনিস মাহমুদ, মো. সাজিদ হোসেন, মঈনুল ইসলাম, সোয়েল রানা, সৌরভ দাশ, সাবিনা ইয়াসমিন, জুয়েল শীল, সৈয়দ আশরাফুল আলম, মো.সাইয়ান, সুমন ইউসুফ, মো. হাসান মাহমুদ, মো সাদ্দাম হোসেন, মোহাম্মদ দিনার মাহমুদ ভূঁইয়া, শুভ্র কান্তি দাশ, মো. তানভীর আহাম্মেদ, দীপু মালাকার ও এম সাদেক।
প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনার পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে গণ-অভ্যুত্থানের আলোকচিত্র ধারণ করেছেন। সেসবের প্রদর্শনী ও প্রকাশনাও করেছেন। এর মধ্যে একটি বড় প্রকাশনা ছিল অরুণ প্রাতের তরুণ দল: সংগ্রামের শত রঙ নামে। আলোকচিত্রী তানি জেসমিন ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশ করেছেন বইটি। এতে রয়েছে তাঁর তোলা প্রায় ১৮০টি ছবি। প্রতিটি ছবিতে তারিখ ও স্থানের উল্লেখ রয়েছে। তিনি ৭ জুলাই থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহর ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গণ-অভ্যুত্থানের বিভিন্ন ঘটনার ছবি তুলেছেন। এই ছবির বইটির একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এতে আন্দোলনের দৃশ্য ও গ্রাফিতির ছবির পাশাপাশি সরকার পতনের পর ৭ আগস্ট থেকে শিক্ষার্থীদের রাজধানী ঢাকার শহরের পথে পথে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, আবর্জনা পরিষ্কার করা এবং সেপ্টেম্বরে ত্রাণ তৎপরতার অনেক আলোকচিত্র সংযোজিত হয়েছে।
ওডস টু আ বাংলাদেশ রিবর্ন নামের গ্রাফিতি নিয়ে একটি বড় বই প্রকাশ করেছে নিউ বাংলাদেশ ফোরাম। সম্পাদনা করেছেন তানজির রহমান অনিম। এই বইয়ের বিশেষত্ব হলো এতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আঁকা বেশ কিছু গ্রাফিতি রয়েছে। দেড় শর মতো গ্রাফিতির ছবি আছে এতে। প্রতিটি ছবির পাশে তুলে ধরা হয়েছে গ্রাফিতির বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। ছবি তুলেছেন সৈয়দ জাকির হোসেন, কমল দাস, আজহার উদ্দিন ও এ মাহমুদ।
ব্যক্তি উদ্যোগ বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হয়তো আরও অনেক বই ও অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে। সবগুলোর তথ্য এখানে দেওয়া সম্ভব হলো না, তবে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যেকোনো উদ্যোগই সমকালকে অতিক্রম করে ইতিহাসের উপাদান হয়ে থাকবে।