ফুটপাতের দোকান থেকেও রেকার বিল নিচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ!

প্রকাশিত: ৮:১৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৩, ২০২৩

এসএম দেলোয়ার হোসেন:
এবার ট্রাফিক পুলিশের নজর পড়েছে ফুটপাতে ভাসমান দোকানের ওপর। ফুটপাতের এসব দোকানিদের কাছ থেকেও ট্রাফিক পুলিশ ‘রেকার বিল’ আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিটি দোকান থেকে ১২শ টাকার রেকার বিলের রসিদ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্ষুদ্র এসব দোকানিকে। এসময় ফুটপাতের পাশে পুলিশের একটি রেকার গাড়ি দাঁড় করানো থাকে। সংশ্লিষ্ট সার্জেন্ট অথবা টিআই (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) ভাসমান দোকানে যান। তিনি রেকার গাড়ি দেখিয়ে বলেন, রেকার বিল দিবি। তা মোবাইল ব্যাংকিং অথবা সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশের ডিসি (উপ-কমিশনার) অফিসে জরিমানার টাকা জমা দিতে হয় না। নগদ টাকায় বিল পরিশোধ করতে হয়। রেকার বিলের রশিদ ধরিয়ে দেওয়া সংশ্লিষ্ট সার্জেন্ট বা টিআই’য়ের হাতে ১২শ টাকা ধরিয়ে দিলেই মুক্তি।
এ ধরনের রেকার বিলের রসিদ ধরিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর পান্থপথ, ফার্মগেট, গ্রিন রোড, এ্যালিফেন্ট রোডসহ বেশ কয়েকটি এলাকার ফুটপাতের ভাসমান দোকানকে ঘিরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পান্থপথ সড়কের ফুটপাতের (পশ্চিম পাশ) পাশে গত ১৭ জুন রেকার গাড়ি দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন ভাসমান দোকান থেকে রেকার ‘বিল’ নিয়ে যায় ট্রাফিক পুলিশ। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২০ জুলাই বসুন্ধরা শপিং মলের বিপরীতে ফার্নিচার মার্কেটের সামনের ফুটপাতে ট্রাফিক পুলিশ অভিযান চালায়। ফার্নিচার মার্কেটের সামনের ফুটপাত থেকে পান্থপথের মোড় পর্যন্ত আনুমানিক ২শ ভাসমান দোকান। ফুটপাতে চায়ের দোকান, পিঠা বিক্রির দোকান, ফলের দোকান, জুতা-স্যান্ডেলের দোকান, ফুসকা-চটপটির দোকান এমনকি ঝালমুড়ির দোকান রয়েছে। এসব দোকান ভাসমান। কেউ ভ্যানগাড়ির ওপর, কেউবা কাঠের চৌকি আবার কেউবা ত্রিপল বিছিয়ে দোকানের পসরা সাজিয়েছেন। টিআই হাবিবের নেতৃত্বে ট্রাফিক পুলিশের একটি দল ফুটপাতজুড়ে এ অভিযান চালায় বলে ভুক্তভোগীরা জানান।
ফুটপাতের ভাসমান দোকানিদের অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা ঘুরে ঘুরে কারো কাছ থেকে ১২শ’ টাকা, কারো কাছ থেকে ৬শ’ আবার কারো কাছ থেকে ৫শ টাকা রেকার বিলের নামে টাকা আদায় করেন। এভাবে টাকা আদায়ের সময় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা তাদেরকে বলেন, ফুটপাতে ব্যবসা করতে হলে দোকানপ্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। না হলে সব দোকান রেকার গাড়ি দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে।


ফুটপাতের ভাসমান দোকানদারের মধ্যে ১২ জনের কাছে রেকার বিলের রসিদ পাওয়া গেছে। একটি রসিদে লেখার তারিখ ২০-৭-২০২৩, রেকার স্লিপ নম্বর ১৩১২৭৩, ব্যবহৃত রেকান নম্বর-৪, রেকারকৃত গাড়ির ধরণ-ভ্যান, রেজিস্ট্রেশন নম্বরের ঘরে লেখা রয়েছে দোকান, মালিকের নাম-হাসান। ১২শ’ টাকা আদায় করা হল। আদেশক্রমে উপ-কমিশনার, ট্রাফিক রমনা বিভাগ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এরকম আরেকটি স্লিপের তথ্য উল্লেখ করা হল। ওই স্লিপে তারিখ রয়েছে ১৭-৬-২০২৩, রেকার স্লিপ নম্বর-১২৭১৮০, ব্যবহৃত রেকার নম্বর ২, রেজিস্ট্রেশন-নম্বরবিহীন, মালিকের নাম আব্দুর রাজ্জাক, রেকার বিল-১২০০ টাকা। এ ধরনের ১২টি স্লিপ  ফুটপাতের দোকানিদের কাছে দেখা গেছে। তারা বলছেন, ফুটপাত উচ্ছেদে মূলত কাজ করেন থানা পুলিশ ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। এবারই নতুন আইন দেখলাম। ট্রাফিক পুলিশও ফুটপাতের দোকানে হানা দিয়ে দোকানিদের হাতে রেকার বিল ধরিয়ে দিয়ে দোকানপ্রতি ন্যূনতম ৫শ’ থেকে ১২শ’ টাকা করে কথিত জরিমানার নগদ টাকা তুলে নিচ্ছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার জয়নুল আবেদীন বলেন, সাধারণত সড়কে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা করলে, ফুটপাতে যানবাহন পার্কিং করে মানুষ চলাচলের বাধাগ্রস্ত করলে অথবা কোন যানবাহন সড়কে নষ্ট হয়ে গেলে ট্রাফিক পুলিশ রেকার গাড়ি দিয়ে প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে। এক্ষেত্রে রেকারিং বিল ১২শ টাকা দিতে হয়। রেকার বিল সরকারি কোষাগারে জমা হয়। কিন্তু ফুটপাতে ভাসমান দোকানের ক্ষেত্রে রশিদ ধরিয়ে দিয়ে রেকার বিল আদায় করার কোনো অভিযোগ এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে নেই বা কেউ অভিযোগ নিয়ে আসেনি। এরকম কোনো ঘটনা ঘটার প্রশ্নই ওঠে না। তবে কেউ যদি কারো অগোচরে এমন কাজ করে থাকেন, সেটি অবশ্যই তদন্ত হবে। তদন্তে সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম বলেন, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি মিলে রাজধানীতে অন্তত দুই লাখ হকার আছেন। তাদের কাছ থেকে দোকানপ্রতি কম করে হলেও প্রতি মাসে ৫শ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। সে হিসাবে ফুটপাত থেকে দৈনিক ১০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়। চাঁদাবাজির বিষয়টি প্রশাসনের সবাই জানে। অথচ চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কারণ চাঁদার টাকা কমবেশি সবাই পায়।
ফুটপাতে ভাসমান দোকান থেকে রেকার বিল আদায় প্রসঙ্গে হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম বলেন, রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ রেকারের ভয় দেখিয়ে টাকা নিচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এটা এক ধরনের নিরব চাঁদাবাজির মতো ঘটনা বলা যেতে পারে বলে জানান বাংলাদেশ হকার্স লীগের এই নেতা।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স শাখায় যোগাযোগ করা হলে ডিসি মো. ফারুক হোসেন বলেন, ফুটপাতের ভাসমান দোকান থেকে রেকার বিল আদায় করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে সরকারের এই রশিদ ব্যবহার করে, সেটির দায়ভার তার। বিষয়টি তদন্ত করা হবে। তদন্তে প্রমান পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।