নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
‘অনেকটা পৈত্রিক সম্পত্তির মতো বংশপরম্পরায় গোলাপ চাষ চলে। আমার এক ভাই ২০০০ সালে এর চাষ শুরু করে। আমি করি ২০১০ সালে। আমার ক্ষেতের গোলাপ গাছের বয়স এখন ১৪ বছর। এখনো ফুল দিচ্ছে। আশা করি আরও ১৫ বছর ফুল দেবে। আমার এই চার বিঘা আয়তনের ক্ষেতের উৎপাদিত ফুল বিক্রির আয়েই সংসার চলে। দুই সন্তান লেখাপড়া করে।’ এসব কথা বলেন ঢাকার সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নের বাগ্রীবাড়ি এলাকার আনোয়ার হোসেন।
চাষের ফুল বিক্রি করে মাসে ৩০ হাজার টাকা লাভ থাকার কথা জানান তিনি গোলাপ ছাড়া ‘আমি দুই শতাংশ জমিতে লিলিয়াম চাষ করেছি। প্রতিটি স্টিক ১০০ টাকা বিক্রি করি। গত বছর ৪০০ বাল্ব (কন্দ) দেয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)। এই বাল্ব থেকে চাষ বাড়িয়েছি। এ বছর ৪৫ হাজার টাকার লিলিয়াম বিক্রি করেছি। সামনের বছর লিলিয়াম আরও বেশি জমিতে চাষ করব।’
সাভারের আনোয়ার হোসেনের মতো অনেক চাষিই এখন ফুলচাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশে উৎপাদিত ফুলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা প্রভৃতি। এসব ফুল সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। তা ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিন, মাতৃভাষা দিবস, ভালোবাসা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, পূজা-পার্বণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফুলের কদর দিনদিন বেড়ে চলেছে। ফুলচাষে সরকারের তেমন প্রণোদনা নেই। তবে লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এটি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষকেরা। দেশে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ফুলের বাজার থাকলেও রপ্তানি আয় খুবই কম বা নামেমাত্র বলে জানালেন ফুল নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন।
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) থেকে জানা গেছে, দেশে ২৪ জেলায় প্রায় ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফুল চাষ হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের কথা বলতে গেলে যশোর জেলার কথা প্রথমেই উচ্চারিত হয়। ১৯৮৩ সালে এই জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামের শের আলী প্রথমবার বাবসার উদ্দেশ্যে ০ দশমিক ৮৩ ডেসিম্যাল জমিতে রজনীগন্ধ্যা ফুল চাষ করেন। এরপর আস্তে আস্তে ফুলের বাজার ও চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে ফুল উৎপাদনে জড়িত আছেন প্রায় ১৫ হাজার কৃষক। এ ছাড়া ফুল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসায়ে অন্তত দেড় লাখ মানুষ সরাসরি নিয়োজিত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ফুল চাষ হয়েছে ৩৮৯৯ একর জমিতে, উৎপাদন হয়েছে ২৮৪৪৪ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ফুল চাষ হয়েছে ৩৯৩০ দশমিক ৬৯ একর জমিতে ও উৎপাদন হয়েছে ৩২১২০ দশমিক ৬১ মেট্রিক টন। পরিসংখ্যানই বলে দেয় ধীরে ধীরে বাড়ছে ফুল চাষের উৎপাদন।
আজিজুর রহমান পেশায় ফুলচাষি। বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা ইউনিয়নের ঢালিপাড়া এলাকায়। তিনি ছয় বিঘা জমি বর্গা নিয়ে গোলাপ, জারবারাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুুল চাষ করেছেন। খরচ বাদে মাসে ৩০ হাজার টাকা থাকে তাঁর। সরকারের থেকে কোনো প্রণোদনা না পেলেও বারি থেকে ৪০০টি লিলিয়াম জাতের ফুলের বাল্ব বিনাম‚ল্যে পেয়েছেন। লিলিয়াম চাষে সীমিত খরচ হওয়ায় ভালো লাভ করেছেন বলে জানান আজিজুর রহমান।
যশোরের ঝিকরগাছায় প্রতি অর্থ বছরে ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকার ফুলের বাজার থাকে বলে জানান স্থানীয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ। তিনি বলেন, ঝিকরগাছায় ডিসেম্বর মাস থেকে ফুল বিপণন শুরু হয়। ফুল ভালো ব্রিক্রি হয় মার্চ মাস পর্যন্ত।’ তিনি ফুলচাষীদের কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে বলেন, ‘ফুল নিয়ে সরকারের কোনো প্রণোদনা নেই। তবে বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) কৃষকদের জন্য কয়েকটি শেড করে দিয়েছে। সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে গেলে ফুলচাষিদের বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়। আবার, বেসরকারি সংস্থা সহজে ঋণ দিলেও বেশি সুদ নিচ্ছে।’
এদিকে ফুল ব্যবসার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয় রাজধানীর শাহবাগ মোড়ের ফুলতলা ফ্লাওয়ার শপের মালিক মমিনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি সাধারণত যশোর ও ঢাকার সাভারের বিভিন্ন চাষির কাছ থেকে ফুল কিনে এনে বিক্রি করেন। মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ফুল বিক্রি করে দোকানের কর্মচারীদের বেতন দিয়েও আমার ৪০ হাজার টাকা প্রতি মাসে লাভ হয়।’ বিদেশে ফুল রপ্তানি করেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিদেশে রপ্তানি করি নাই কখনও, বরং চাহিদা থাকায় বাইরের দেশ থেকে বিভিন্ন ফুল এনে বিক্রি করি। অনেক সময় দেশের ফুল ছোট ও মান একটু খারাপ হয়।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, কাট ফ্লাওয়ার ক্যাটাগরিতে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ফুল রপ্তানি হয়েছে ৫৯ কোটি ৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে তা কমে গেলেও ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৮৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকার ফুল রপ্তানি হয়েছে। ফুলের এই রপ্তানি বাজারে কাট ফ্লাওয়ার ছাড়াও বিভিন্ন উদ্ভিদের কন্দ ও চারা রপ্তানি হয়েছে ভারত, জাপান ও কাতারে।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির ঢাকা বিভাগের সভাপতি বাবুল প্রসাদ বলেন, ‘কিছু ফুল মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে। এসব ফুল ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েকজন ব্যবসায়ী আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠানোর মতো ফুল আমরা এখনো উৎপাদন করতে পারিনি। এখানে প্রযুক্তিগত সমস্য আছে, আর্থিক সমস্যা আছে। অর্গানিক (ক্ষতিকর বালাইনাশক ছাড়া) উপায়ে ফুল চাষ আমরা করতে পারি না। আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার। ফুল রপ্তানি করতে হলে আগে গ্রিন হাউজে বা পলি হাউজে অর্গানিক চাষ করতে হবে তাহলে বাইরে চাহিদা হতে পারে। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হলে বাইরের দেশের ব্যবসায়ীরা নিতে চান না। আমরা অনেক সময় নমুনা পাঠিয়েছি তাঁরা বলেন অর্গানিক উপায়ে চাষ হলে নেবেন।’
রপ্তানি আয় বাড়াতে হলে চাষিদের প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দেওয়ার কথা জানান বাবুল প্রসাদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের ফুল চাষিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ আন্তরিক আছেন। বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ বাড়াতে তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশাকরি রপ্তানি আয় বাড়বে।
বারির ফুল বিভাগের প্রধান ফারজানা নাসরীন খান বলেন, ‘আসলে আমাদের দেশ থেকে সেভাবে ফুল রপ্তানি হয় না। আগে পান ও ফুল একই কোডে বিদেশে রপ্তানি হতো। এখন ফুল রপ্তানির আলাদা কোড হয়েছে, এটা খুবই ভালো দিক। অনেক ব্যবসায়ী আত্মীয়ের মাধ্যমে কিছু ফুল পাঠিয়েছে। সেগুলো রপ্তানি হিসেবে গণনা করা হচ্ছে। তবে, নিয়মমাফিকভাবে ফুল রপ্তানি করা হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের প্যাকেজিং উন্নতমানের না। কুলিং সিস্টেম (হিমায়িত প্রক্রিয়া) নেই, অর্গানিক পদ্ধতিতে ফুল চাষ না হওয়ায় বাইরের দেশে রপ্তানি হচ্ছে না, তবে ব্যবসায়ীরা চেষ্টা করছেন।’
ফুলচাষিদের জন্য সরকারের প্রণোদনা নিয়ে ফারজানা নাসরীন বলেন, ‘প্রণোদনার বিভিন্ন আঙ্গিক আছে। এই যেমন, লিলিয়াম চাষ উদ্বুদ্ধ করতে যশোর, রংপুর, ঢাকার সাভার ও গাজীপুরের ১৬জন চাষিকে বিনাম‚ল্যে বাল্ব দেওয়া হয়েছে। বিএডিসি ফুল চাষিদের জন্য বিভিন্ন এলাকায় শেড হাউজ তৈরি করে দিয়েছে। স¤প্রতি ইউএসএআইডির (ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) অর্থায়নে ঝিকরগাছার গদখালীতে একটি ফুল সংরক্ষণাগার করা হয়েছে। তবে, সরকারি প্রণোদনা খুবই কম, চাহিদা অনুযায়ী কৃষকেরা পাচ্ছেন না।’
রপ্তানি আয় বাড়াতে হলে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে ফুলের মান ঠিক রাখার পরামর্শ দেন ফারজানা নাসরীন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ফুলের উৎপাদন পরিমান মতো হচ্ছে। রপ্তানি করতে হলে ফুলের রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ হতে হবে। উত্তম কৃষিচর্চা পদ্ধতি ঠিক রাখতে হবে। ক্ষেত থেকে ফুল তোলার পর কুলিং সিস্টেমে সংরক্ষণ ও পরিবহন করতে হবে। এ ছাড়া ফুল কাটতে হবে সঠিক সময়ে। গ্রেডিং ও প্যাকেজিং ভালো হলে ফুল রপ্তানী বাড়বে।