
নোয়াখালী প্রতিনিধি:
যতদূরে চোখের ব্যাপ্তি, ততদূর সবুজ। অনাবাদি নেই একচিলতে জমিও। একসময় আমন ধান কাটার পরই শুষ্ক মৌসুমে মাঠে মাঠে ধুম পড়ত রবি ফসল চাষে। তরমুজ, ডাল, বাদাম, মরিচ, শীতকালীন সবজি, সরিষা, কালিজিরা, সূর্যমুখীতে হাসত চরের মাটি।
তবে কয়েক বছরে বদলে গেছে নোয়াখালীর রবিশস্যের ভান্ডার উপকূলীয় জনপদ সুবর্ণচরের চাষাবাদ। রবিশস্য ছেড়ে বোরো (ইরি) ধান চাষ করছেন কৃষক। শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষই এখন সুবর্ণচরের জন্য অভিশাপ! খাল-বিল-ডোবায় ভরপুর মিঠাপানির রাজ্যে এখন পানীয় জলের হাহাকার।
ধান চাষে ভূগর্ভের পানি অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বাড়িঘরের গভীর নলকূপে এখন আর পানি ওঠে না। পুকুর-জলাশয়েও পানি থাকছে না। সুপেয় পানি কিনে খেতে হচ্ছে অনেককে। এতে গৃহস্থালির কাজে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। বিশুদ্ধ পানির অভাবে সুবর্ণচরের লাখ লাখ মানুষ দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন।
ধান চাষে ভূগর্ভের পানির ওপর অতিনির্ভরতাকে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অঞ্চলে ইরি ধান আবাদ না করলে পানির সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাবে। ইরি ধান চাষাবাদে কৃষককে নিরুৎসাহিত করতে হবে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে তা মহাবিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
সম্প্রতি সরেজমিন সুবর্ণচর ঘুরে দেখা গেছে, একরের পর একর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন কৃষক। কেউ জমিতে সেচ দিচ্ছেন, কেউ আবার সার-কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুবর্ণচরে ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর আবাদি জমি আছে। এর মধ্যে ২০০০ সালে মাত্র ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। বাকি জমিতে হয়েছে রবি ফসলের আবাদ। গত বছর সুবর্ণচরে ১৫ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ ও ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ডালজাতীয় ফসল আবাদ হয়। এ বছর ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান ও ২ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে খেসারি আবাদ হয়েছে। এই ধান চাষে ব্যবহার হয়েছে ৫০ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার ২৮০ কিউসেক পানি। এর মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ পানি ব্যবহার হয় উপরিভাগ থেকে। প্রতি হেক্টর ধান চাষে ৪ লাখ ১৪০ কিউসেক পানি খরচ হচ্ছে।
ধান চাষে কৃষি বিভাগ থেকে উন্নত জাতের বীজ, সার, কীটনাশকসহ সব রকম সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। অথচ রবিশস্য ধ্বংস করে ধান চাষ বিস্তারের কারণে পুরো জনপদ পানিশূন্য হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমলেই নেওয়া হচ্ছে না। উল্টো কোনো পরিকল্পনা ও অনুমোদন ছাড়া স্থানীয় চাষিরা বোরো চাষের জন্য ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ফুট গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলার কারণে উপজেলাজুড়ে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সাধারণত নলকূপের গভীরতা হয় ৮০০-৯০০ ফুট; ব্যবহার করা হয় ১.৫ ইঞ্চি পাইপ। কিন্তু সুবর্ণচরের অনেক নলকূপের ১ হাজার ২০০ ফুট গভীরে বসানো হয়েছে; ব্যবহার করা হয়েছে ৪.৫ ইঞ্চি পাইপ।
সরকারি সংস্থার দায়িত্বহীনতা ও অবহেলায় এখন পানির কষ্টে ভুগছে সুবর্ণচরের মানুষ। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্য বলছে, সুবর্ণচরের চাষাবাদের জন্য ২৪৫টি গভীর নলকূপের (সেচপাম্প) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে চাষিরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরও তিন হাজারের বেশি সেচপাম্প স্থাপন করেছেন, তবে সেগুলো অনুমোদনহীন। একটি গভীর নলকূপ ভূগর্ভ থেকে প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার ৮০০ কিউসেক পানি তোলা হয়। গভীর নলকূপ অনুমোদন দেওয়ার আগে কোনো গবেষণা করেনি। মাটির নিচে কী পরিমাণ পানি আছে কিংবা গভীর নলকূপের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়নি। উল্টো সর্বোচ্চ পানি শোষণকারী উফশী জাতের বীজ কৃষকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
সুবর্ণচরের পূর্বচরবাটা গ্রামের বাসিন্দা অজি উল্যাহ বলেন, ‘ভাই, পানির খুব কষ্ট। কখনও কল্পনা করিনি পানির কষ্টে ভুগব।’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর স্ত্রীর আয়েশা বেগম বলেন, ‘আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছি পানির কষ্ট দূর করে দিতে। এ রকম আর কত বছর চলবে, পানির অভাবে মারা যেতে হবে মনে হচ্ছে।’
সুবর্ণচরের চরমজিদের একটি মসজিদের সামনে গভীর নলকূপে পানি পাওয়া যায়। আর সেই নলকূপ ঘিরে প্রতিদিন থাকে শত শত মানুষের ভিড়। সবার হাতেই কলস বা ড্রাম। চরমজিদের স্কুলশিক্ষক আবদুর রহমান বলেন, এই একটা নলকূপ কয়েক গ্রামের মানুষের ভরসা। কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নারীরা এখান থেকে পানি নেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, অফুরন্ত জলরাশির এই জনপদে বোরো ধান চাষে যেভাবে পানি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে একসময় পানির অভাবে মানুষকে এলাকা ছাড়তে হবে।
চরবাটা খাসের হাট এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ পুকুর শুকিয়ে গেছে। অধিকাংশ নলকূপে উঠছে না পানি। অনেকে বাধ্য হয়ে শ্যালো টিউবওয়েল বসিয়ে ৩০ ফুট নিচের ভূগর্ভের ওপরের পানি তুলছেন।
খাসের এলাকার গৃহিণী আমেনা বেগম বলেন, সংসারে পাঁচ সদস্য। বর্ষা মৌসুমে ঠিকঠাক পানি পেলেও শীত ও খরা মৌসুমে পানির জন্য খুব কষ্ট করতে হয়। বাড়ির নলকূপটির গভীরতা ১৮০ ফুট। এক বালতি পানির জন্য হাত ও কোমরে ব্যথা হয়ে যায়। বেশির ভাগ সময় দূরে গিয়ে গভীর নলকূপ থেকে পানি আনতে হয়।
চরআমানউল্যাহর আছমা খাতুনের ঘরে ঢুকেই বোঝা যায় পানির সমস্যা তাদের কতটা প্রকট। ঘরের ভেতরে কলসি, ড্রাম, থালাবাটি, এমনকি পলিথিনে করেও পানি সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাদের ঘরে এক ফোঁটা পানিরও অনেক মূল্য। আমেনা বলেন, ঘরে একবেলা খাবার জোগাড়ের চেয়ে এই এলাকার মানুষের কাছে খাবার পানির সংস্থান করা বেশি কঠিন।
সুবর্ণচরে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের সুবর্ণচর শাখার আহ্বায়ক আবদুল বারী বাবলু বলেন, এখন ১ হাজার ২০০ ফুট নিচেও পানি মিলছে না। পানিতে লবণের পরিমাণ হঠাৎ বেড়েছে। গভীর বা অগভীর নলকূপ বসানো হয় দেড় থেকে তিন ইঞ্চি আকারের পাইপ দিয়ে। কিন্তু সেচকাজে ব্যবহারের নলকূপে পাইপ দেওয়া হয় ৪ থেকে ১০ ইঞ্চি। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষের পানি সংকট সমাধানে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে ভূগর্ভের পানির মজুতের পরিমাণ জরিপ করতে হবে। অন্যথায় পানির পরিস্থিতি আরও জটিল পড়তে পারে উপকূলীয় এই জনপদে। তিনি বলেন, সুবর্ণচরে বড় বড় খাল ও লেক সেচের আওতায় আনলে দুই লাখ হেক্টর জমি চাষ করা যাবে। ২০ কোটি কিউসেক পানি পাওয়া যাবে শুধু মেঘনা লেক কাজে লাগিয়ে।
সুবর্ণচরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চন্দ্রকলির নির্বাহী পরিচালক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, কৃষি বিভাগের ভুল নীতির কারণেই সুবর্ণচরে পানির জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। রবিশস্য অধ্যুষিত এলাকায় বোরো ধান চাষ না করার বিষয়ে কৃষি আইন আছে। অথচ স্থানীয় কৃষি বিভাগ এ আইন মানছে না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ভূগর্ভের পানি রক্ষায় ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের লক্ষ্যে আমরা কৃষককে রবি মৌসুমে অন্যান্য লাভজনক ফসল চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। বিএডিসির গভীর নলকূপ অনুমোদন বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা আছে। ফলে কত পরিমাণ জমিতে কেমন পানি লাগবে, সেই তথ্য নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। চাষ অনুযায়ী গভীর নলকূপ বসানো হলে অবৈধ নলকূপ স্থাপন কমে আসত।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, অবৈধ গভীর নলকূপের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান চালানো হবে। এ অঞ্চলের কৃষককে উপরিভাগের পানি সঞ্চয় করতে উদ্বুদ্ধ করা হবে।