বন্ধ হয়নি অনুমোদনহীন রেস্তোরাঁ, মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে

বেইলী রোড ট্র্যাজেডির এক বছর

প্রকাশিত: ১২:৪৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ১, ২০২৫


নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

এক বছর পরও রাজধানীর বেইলী রোডের সেই গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডের কোনো কুলকিনারা হয়নি। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি এখনো তদন্তাধীন। ঘটনার পর বেশ কিছু আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হলেও মাস ঘুরতে না ঘুরতে আবারও চালু হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠান। আগের মতোই বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে অনুমোদনবিহীন রেস্টুরেন্টে রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া ও বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১০টার দিকে রাজধানীর বেইলী রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনের নিচতলার সিঁড়ির কাছে একটি কফি শপের ইলেকট্রিক কেটলি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ঐ ভবনের তিন তলায় কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে তখন চলছিল ব্যাপক আয়োজন। আগুনের ধোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য রেস্টুরেন্টে আগতদের অনেকেই একটি কক্ষে আশ্রয় নেন। ঘটনার পর রাত ১২টার দিকে ঐ কক্ষ থেকে ৩৩ জনের লাশ উদ্ধার করে। সব মিলিয়ে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিত্সা নেন। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে।

মামলার তদন্ত: অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরদিন গত বছরের ১ মার্চ রাতে পুলিশ বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা করে। মামলা নম্বর-১। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগ আনা হয়। মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। এখন পর্যন্ত এ অগ্নিকাণ্ডে আট জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন, ভবনের ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল, চুমুক ফাস্টফুডের মালিক মো. আনোয়ারুল হক, চুমুক ফাস্টফুডের ম্যানেজার শফিকুর রহমান, কাচ্চি ভাই-এর ম্যানেজার জেইন উদ্দিন জিসান, কাচ্চি ভাই-এর মালিক সোহেল সিরাজ, ফুকো রেস্টুরেন্টর মালিক আব্দুল্লাহ আল মতিন, এছাড়া অন্যান্য রেস্তোরাঁর মালিক মোহন আলী পলাশ, মো. নজরুল ইসলাম খান।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আনিচুর রহমান বলেন, ‘মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। আশা করছি, খুব দ্রুতই তদন্ত শেষে প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে পারব।’

তদন্ত সূত্র বলছে, সাত তলা ভবনটির পাঁচ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক ও এর ওপরে আবাসিকের অনুমোদন নিলেও পুরোটাই বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। ভবনটির নকশায় দুটি সিঁড়ি থাকলেও তৈরি করা হয় একটি সিঁড়ি। সিঁড়ির এক পাশ দিয়ে রান্নার কাজে ব্যবহূত গ্যাস সিলিন্ডার মজুত করা ছিল যা ঝুঁকিপূর্ণ।

বর্তমানে গ্রিন কোজি কটেজটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সেখানে এখনো মানুষের ভিড় লেগে থাকে। ঐ আগুনে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা এসে কান্নাকাটি করেন। এলাকায় এই নিয়ে এখনো আতঙ্ক রয়েছে।

বাণিজ্যিক ভবনে অনুমোদনবিহীন রেস্টুরেন্টঃ: গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের পর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায় ফায়ার সার্ভিস। এতে বেশির ভাগ এলকায় বহুতল ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল পাওয়া যায়। অভিযান চালিয়ে ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডের ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টারের ১৫টি রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেয়। এই বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য এই ভবনটি নির্মাণ করা হলেও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করার কোনো অনুমতি নেই। এরপরও এই ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট করা হয়। রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ করে দেওয়ার এক মাস পর আবারও চালু হয়। এরকম সাত মসজিদ রোডে মার্শাল প্লাজা, কেবি টাওয়ার, রূপায়ণ জেড আর প্লাজা, ১৩ তলাবিশিষ্ট কেবি স্কয়ার ও জিগাতলা মোড়ে কেয়ারি ক্রিসেন্ট টাওয়ার এই ভবনগুলোতে দেশি-বিদেশি প্রায় ১০০ রেস্টুরেন্ট চালু রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বেইলী রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর তারা অনেক অভিযান চালিয়েছেন। তবে ঐ আগুনের পর অনেক সংস্থা মিলে কিছু সমন্বিত কাজ করার কথা ছিল। সেই কাজের অগ্রগতি কী তা ফায়ার সার্ভিস বলতে পারবে না। তিন বলেন, তবে এটুকু বলতে পারি, ফায়ার সার্ভিস বসে নেই। তারা নিয়মিত কাজ করছে।

অনুমোদনবিহীন ছাদ রেস্তোরাঁ: ছাদ রেস্তোরাঁ বা রুফটপ রেস্টুরেন্টের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। মেট্রোরেল চালুর পর থেকে বিশেষ করে মিরপুর অঞ্চলেই ছাদ দখল করে চালু হয়েছে প্রায় শখানেক রেস্টুরেন্টে। মিরপুর ১ থেকে ১২ এলাকায় ছাদে রেস্টুরেন্টের সংখ্যা অনেক বেশি। এছাড়া উত্তরা, ধানমন্ডি, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, বাংলামোটরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অসংখ্য ছাদ রেস্তোরাঁ দেখা গেছে। রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী ছাদে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি না থাকলেও উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে আরো অনেক রেস্তোরাঁ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেস্তোরাঁ চালুর আগে রাজউক, সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত কোনো ছাদেই রেস্টুরেন্ট করার অনুমতি দেয়নি সংস্থাগুলো। এর মধ্যে বেশির ভাগই চলছে অবৈধভাবে।

রাজউকের সুপারিশ কাগজে কলমে: গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউকের তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের ছয়টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়। এর বেশির ভাগেই বাস্তবায়ন হয়নি। প্রথমটি ছিল ভবন ব্যবহারের সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) ছাড়া কোনো ভবনে গ্যাস, পানি, বিদ্যুত্ ইত্যাদি সেবা সংযোগ না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো ভবন মালিক নির্মাণকাজ শুরু করলেই আবেদন করে বিদ্যুত্ ও পানির সংযোগ পাচ্ছেন।

রাজউকের দ্বিতীয় সুপারিশ অনুযায়ী যারা ভবন নির্মাণের নকশা করেন, নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তারা যেন নির্মাণকাজে অনিয়ম থাকলে তা উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেন। কিন্তু গত এক বছরে রাজধানীতে শত শত নতুন ভবন উঠলেও কোনো ভবনের নির্মাণকাজে সামান্যতম অনিয়ম হয়েছে বলে রাজউকে কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি। তৃতীয় সুপারিশ ছিল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলপি গ্যাস সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়মিত পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিত করবে। কিন্তু গ্যাস সরবরাহকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই কোনো ভবনে গিয়ে তাদের সরবরাহ করা সিলিন্ডারগুলো ভোক্তা সঠিক নিয়মে ব্যবহার করছে কি না, সেটি তদারক করেনি।

চতুর্থ সুপারিশ ছিল, পাঁচ তলা বা তদূর্ধ্ব আবাসিক কাম বাণিজ্যিক বা শিল্পকারখানার ভবনে প্রতি তিন মাস পর অগ্নিমহড়া পরিচালনা করাটা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ। বাস্তবে এর বাস্তবায়ন তেমন হয়নি। রাজউকের পঞ্চম সুপারিশে ফায়ার লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের ক্ষেত্রে রাজউকের ব্যবহার সনদ বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফায়ার কর্তৃপক্ষ কিছুটা সচেতন থাকলেও রাজউকের দেওয়া ব্যবহার সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) ইস্যুর বেলায় উেকাচ বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। ফলে অনেক ভবন মালিক অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে আগ্রহ দেখাননি। রাজউকের ছয় সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য এক সমন্বয় সভায় বলা হয়েছে, সেবা সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকায় থাকবে রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কোনো সংস্থার তদারকি কখনো চোখে পড়েনি।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, দেশের পরিস্থিতির কারণে এতদিন বন্ধ ছিল অভিযান। তবে শিগিগরই অভিযান জোরদার করা হবে।

এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, রাজউক নিয়মিত ভবন পরিদর্শনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আদালতের আদেশে রেস্টুরেন্টগুলো খুলে দেওয়া হলেও তারা শর্ত মানছে কি না, সেটিও দেখা হচ্ছে। নতুন ভবন তৈরির সময় রাজউকের লোকজন তদারকি করছে।