বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের এত তাড়া কেন?

প্রকাশিত: ১:১২ অপরাহ্ণ, মার্চ ৯, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক:

স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার সর্বস্তরে যে ক্রীড়নক, স্তাবক প্রশাসনিক কাঠামো ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে গেছেন তার মূলোৎপাটন, পুনর্গঠন ও সংস্কার সত্যিই আজ এক বাস্তবতা। একইসঙ্গে মুনাফাখোর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক ভারসাম্য ও গতিশীলতা ফেরানো জরুরি।

ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি সহনশীল এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা ও জননিরপত্তা বিধান সবচেয়ে অগ্রাধিকার হওয়া বাঞ্ছনীয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার বিগত সাত মাস দেশি-বিদেশি নানা অযাচিত উৎপাত এবং কথিত আন্দোলন, দাবি-দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ-সংগ্রাম মোকাবিলায় বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন।

রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠন ও সংস্কার দূরে থাক, একটি সুষ্ঠু, অবাধ, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার মতো প্রস্তুতি নেওয়াও সম্ভব হয়নি। সুতরাং সবকিছুর আগে সরকারের স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। অন্তর্র্বতী সরকারের প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিদ্যমান প্রশাসনের মধ্যে বোঝাপড়ার ঘাটতিও দূর হয়নি।

এত বছরের রাষ্ট্রকাঠামোতে আহামরি সিস্টেম ডেভেলপ হয়নি বা রাষ্ট্রকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর (ফাংশনাল) করা যায়নি। বরং যেটুকু করা গেছে হাসিনার স্বৈরাচারী দেড় দশকে তাও ভেঙে পড়েছে। এছাড়া রক্তাক্ত একটি গণবিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্রের সর্বস্তরের ভারসাম্য এবং আদেশ, নির্দেশ ও আনুগত্যের জায়গা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই কারণে সরকার ও প্রশাসনে স্থবিরতা অসম্ভব কিছু নয়। এখন প্রয়োজন সরকার ও প্রশাসনে পারস্পরিক বোঝাপড়া, গতিশীলতা, প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং রাজনৈতিক ও জাতীয় ঐক্য। তারপরই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভাবার বিষয়টি আসতে পারে।

জাতীয় নির্বাচনের আগেই রাষ্ট্রের গোটা সিভিল প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং এর প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুনর্গঠন ও সংস্কার অতীব জরুরি। সংসদের নির্বাচনী এলাকা পুনর্বিন্যাস ও বিশ্বাসযোগ্য ভোটার তালিকা হালনাগাদের বিষয়টিও আবশ্যিক।

নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত এবং মৃত্যুজনিত কারণে ভোটার তালিকা সংশোধনের বিষয় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নতুন নির্বাচন কমিশনকে এজন্য যৌক্তিক সময় দেওয়া জরুরি। কোনো রাখঢাক না করেই বলছি, উল্লেখিত প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করাসহ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে না এনে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না করে, মূল্যস্ফীতির মোটামুটি টেকসই সমাধান না করে এবং ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার পুনর্বাসন ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় না পৌঁছা পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচন ন্যূনতম সমাধান নয়। বলা যায়, তাড়াহুড়ো করে যেনতেন নির্বাচন দেশের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার নিশ্চায়ন করে না।

বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞদের অনুমিত ধারণা ও বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, সব স্তরে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করতে কমপক্ষে তিনবছর সময় প্রয়োজন। বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্রের সর্বস্তর, রাজনীতি ও অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফেরানো প্রয়োজন। তার আগে নির্বাচন হলে আগের জায়গায় ফিরবে দেশ। সুতরাং রাষ্ট্রকাঠামোর সার্বিক পুনর্গঠনের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের যে দাবি উঠেছে তা যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। অনস্বীকার্য, বিপ্লবোত্তর জনআকাঙ্খা ধারণে বিএনপির মতো বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তির অবস্থান নিয়ে জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার, সংবিধান পুনর্লিখন ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ প্রশ্নে। এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট সমাধানই মূলত ভবিষ্যৎ রাজনীতির ইতিবাচক স্থিতিশীলতা ও গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হওয়ার কথা।

যদি সত্যিই জুলাই বিপ্লব ঘোষণা না হয় অথবা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখন না হয়, সর্বোপরি রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার ছাড়া আমরা জাতীয় নির্বাচনের দিকে মনোযোগী হই; তবে জেনে রাখুন, দেশ অবধারিতভাবে এত বছরের পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক জঞ্জালকে উতরাতে পারবে না। সংকট জিইয়ে থাকলো।

আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনে ভারত, কিছু পশ্চিমা মোড়লের একাট্টাকে সমর্থন জানানোর ইঙ্গিত হলো দ্রুত নির্বাচন দাবি। দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বুঝে বা না বুঝে সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। অথবা গণবিপ্লবের পর নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তি বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় কিনা এমন আশঙ্কা থেকে দ্রুত নির্বাচন দাবি বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের জন্য প্রাসঙ্গিক।

 

ইতিহাস বলছে, দেশে বড় আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পরই নতুন শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। উদাহরণ ৭৫, ৯০ এর পটভূমি। বিশেষ করে পঁচাত্তরের অভ্যুত্থান ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বেনিফিশিয়ারি দলের নাম বিএনপি। পঁচাত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার বাকশালের পতনের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠা লাভ এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া, একইভাবে নব্বইয়ে সামরিক শাসক স্বৈরাচার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনে বিএনপির ফের ক্ষমতায় ফেরা অন্যতম দৃষ্টান্ত। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বিএনপি এখন নিজেদের ক্ষমতার কাছাকাছি ভাবছে। তবে দ্রুত নির্বাচন না হলে সে সুযোগ হাতছাড়া হয় কিনা এমন ভয় দলটির মধ্যে থাকা অতীত ইতিহাসের বাস্তবতা।

বিভিন্ন মাধ্যমে গুঞ্জন রয়েছে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে ভারত পশ্চিমা কোনো কোনো লবিকে কাজে লাগাচ্ছে। লীগকে রাজনীতিতে ফেরাতে দেশের প্রধান সারির রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে নেপথ্যে ভারতের হয়ে পশ্চিমা শক্তি মধ্যস্থতা করছে। চলছে দেনদরবার, সুপারিশ।

বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন অথবা গণপরিষদ নির্বাচন এবং সংবিধান পুনর্লিখন এর কোনোটিই যেন আলোর মুখ না দেখে এবং দ্রুত নির্বাচন করার তাগিদের নেপথ্যে তিনটি বিষয় জড়িত থাকতে পারে।

এক. আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা,

দুই. দ্রুত বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব বলয়ের দ্বারকে উন্মুক্ত করা,

তিন. ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেও প্রধান রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতা হারানোর ভয়।

অনুমিত বিষয়গুলোই মূলত দ্রুত নির্বাচন চাওয়ার পেছনে দেশি-বিদেশি শক্তির যোগসূত্রকে ইঙ্গিত করে। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে ভারতের অবস্থান প্রকাশ্য। নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে তারা আগ্রহের কথা জানাচ্ছে হরহামেশাই। ৭ মার্চ দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের প্রসঙ্গ তাদের আগ্রহের কথা জানান।

কিছুদিন আগে একই মত সামনে এসেছে দেশটির সেনাবাহিনীর প্রধানের একটি বক্তব্যেও। শুক্রবার রণধীর জয়সওয়াল বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়েও অনধিকার চর্চা করেছেন। যা কূটনীতির শিষ্টাচার বর্জিত। তাই বলছি, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের এত তাড়া কেন? সম্ভবত উপরোক্ত আলোচনা থেকে এর ধারণা কিছুটা হলেও আমরা স্পষ্ট করতে পেরেছি।

উপসংহারে বলবো, আমরা জার্মানির নাৎসি বাহিনীর ইতিহাস জানি। ফ্যাসিস্ট নাৎসিজমকে জার্মান বা ইউরোপে ফেরার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাহলে বাংলাদেশে গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের ফেরার পথ কীভাবে তৈরি হতে পারে? এই প্রশ্ন নিশ্চিত অপ্রাসঙ্গিক নয়। ভারতসহ লীগের পশ্চিমা মিত্রদের আমরা বলবো, আপনারা যদি ইউরোপে নাৎসিকে ফেরানোর সুযোগকে ‘না’ হিসেবে সাব্যস্ত করেন, তাহলে জনরোষে পলায়ন এবং পতিত ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে পুনর্বাসন চিন্তা অবশ্যই দ্বিচারিতা।

বারবার গণহত্যা, গণতন্ত্র হরণ, ফ্যাসিজম ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম করে আওয়ামী লীগের পতন হবে, আর আমরা তাদের বারবার সুযোগ দেবো?

বিংশ শতাব্দীর বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর এবং একবিংশ শতাব্দীর নয় থেকে চব্বিশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস একই। এরপরও একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে লীগকে ফেরানোর সুযোগ দানের অর্থই হলো অস্থির সমাজ, অস্থির রাজনীতি ও অস্থির জাতিরূপে দুনিয়ার সামনে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা।