ড. প্রকৌশলী রিপন হোড়,রিসার্চ স্কলার,ইউনিভার্সিটি অব কুইবেক,কানাডাঃ
বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে একটি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে চলেছে। তীব্র দাবদাহের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত প্রায়। আবহাওয়া দপ্তরের মতে, কিছুদিনের মধ্যেই মৌসুমি বৃষ্টি শুরু হলে তাপমাত্রা কমে যাবে। সম্প্রতি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র তাপমাত্রা নানা দিক থেকে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। গত ৩০ এপ্রিল যশোরে ৪২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, যা ছিল গত ৩৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর আগে ১৯৮৯ সালের ২১ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল বগুড়ায় ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুধু তাপের তীব্রতা নয়, স্থায়িত্বের দিক থেকেও এবারের তাপপ্রবাহ ৭৬ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
গত ৭৬ বছরে তাপের ব্যাপ্তি আর কখনোই এত দীর্ঘ হয়নি। নিকট অতীতে গত বছর (২০২৩) তাপপ্রবাহের টানা ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৬ দিন। আর ২০১০ সালে রাজশাহীতে ২০ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে গিয়েছিল। তবে তা ধারাবাহিক বা টানা ছিল না। মাঝে মাঝে গ্যাপ দিয়ে এই তীব্র দাবদাহ প্রবহমান ছিল। অনেক দিন ধরেই দেশের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে ছিল। সেই দিক বিবেচনা করলে এবারের চলমান তাপপ্রবাহ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন প্রকৃতির।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের তাপমাত্রার তীব্রতা বেড়ে তা ক্রমশ অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে কেন? কোনো জনপদের তাপমাত্রার তীব্রতা বেড়ে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই মূলত তাপমাত্রার তীব্রতা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত প্রভাব কাজ করছে। একটি জনপদের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকলে সেই জনপদের আবহাওয়ার স্বাভাবিকতা বজায় থাকে। কোনো কারণে এর ব্যত্যয় ঘটলে তাপমাত্রার স্বাভাবিকতা ক্ষুণ্ন হয়। এমনকি সেই জনপদ মানব বসতির অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে। সরকারি হিসাবমতে, বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৫ শতাংশের মতো বনভূমি রয়েছে। তবে কোনো কোনো সূত্রমতে, বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ৮ থেকে ৯ শতাংশের মতো। প্রতি বছরই নির্বিচারে বনভূমি নষ্ট করা হচ্ছে। সেই তুলনায় নতুন বনভূমি সৃজনের তেমন কোনো প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। এই নগরায়ণ করার ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধিবিধান, বিশেষ করে বৃক্ষ এবং জলাধার রক্ষার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। একসময় রাজধানী ঢাকা শহরের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো খাল প্রবাহিত হতো। এছাড়া ছিল বিপুলসংখ্যক জলাধার। এসব জলাধারের পানি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখত। কিন্তু আমাদের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের কারণে রাজধানীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত অধিকাংশ খাল ও জলাধার ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।
জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী একটি কমন সমস্যা। উন্নত দেশগুলোতে গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত শিল্পায়নের কারণে কার্বন নিঃসারণ বাড়ছে। আবার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমাদের উদাসীনতা আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য অনেকটাই দায়ী। বাংলাদেশ ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ। কিন্তু এখন আমাদের সেই ঋতুবৈচিত্র্যও হারাতে বসেছে। এখন শীতকালের স্থায়িত্ব এবং শীতের তীব্রতা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। বর্ষাকালে আগের মতো বৃষ্টি হয় না। আবার অনেক সময় অতি বৃষ্টির কারণে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। এই অবস্থার জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে আমাদের পরিবেশবিরোধী আচরণ। আমরা যে হারে বৃক্ষ কর্তন করছি, সেইভাবে নতুন বৃক্ষ রোপণ করছি না। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষে সমৃদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। গাছপালা শিকড় দিয়ে মাটি থেকে পানি টেনে নেয়। সেই পানি ডালপালা এবং পাতায় সংরক্ষণ করে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় পানি পাতার নিচের দিকে থাকা ছোট ছোট গর্তে সঞ্চালিত হয়। পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে তা জলীয় বাষ্পে পরিণত হয় এবং বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এটি প্রাকৃতির ‘এয়ার কন্ডিশন’ হিসেবে কাজ করে। গাছের সংখ্যা কমে গেলে প্রকৃতির এই স্বাভাবিক প্রথা বিঘ্নিত হয়। ফলে দেখা দেয় নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। একটি জনপদের পরিবেশের স্বাভাবিকতা নিশ্চিত করার জন্য বৃক্ষের কোনো বিকল্প নেই। বৃক্ষ মানুষকে ছায়া দেয়। ফল দেয়। পশুপাখির আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। ঢাকাসহ বাংলাদেশের শহরগুলোতে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। যেহেতু শহরাঞ্চলে জমির পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম, তাই বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের প্রবণতা বাড়ছে। বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশের ভারসাম্যের বিষয়টি নিদারুণভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। শহরের রাস্তাগুলো নির্মাণকালে তার দুপাশে উন্মুক্ত স্থান রাখা হচ্ছে না। ফলে চাইলেও এসব রাস্তার পাশে বৃক্ষ রোপণ করা যাচ্ছে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে রাস্তার পাশে গাছ লাগানোর বিষয়টিও আমাদের উপলব্ধির মধ্যে আসছে না।
শহরে যেসব বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, তাতে নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ইট, সিমেন্ট, কাচ ও ইস্পাতের মতো কঠিন ধাতব বস্তু ব্যবহার করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ভবনে আধুনিক ও পরিবেশসম্মত পানি নিষ্কাষণরে ব্যবস্থা থাকে না। ভবন নির্মাণের কাজে যেসব ধাতব বস্তু ব্যবহার করা হয়, তার রং সাধারণত কালো, বাদামি অথবা ধূসর হয়ে থাকে। কালো বস্তু আলোকশক্তির সব তরঙ্গ দৈর্ঘ্য শোষণ করে তাপে রূপান্তরিত করে। এর বিপরীতে সাদা বস্তু আলোক তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করে। কালো বা অন্যান্য রং তাপমাত্রা বাড়ায়, কিন্তু সাদা রং বা বস্তু আলোকে তাপে রূপান্তর করে না। ফলে সাদা রঙের ওপর আলোক বর্ষিত হলে তাতে তাপমাত্রা তেমন একটা বাড়ায় না। বহুতল ভবন নির্মাণকালে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয়, তা যদি সাদা রঙের হয়, সে ক্ষেত্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম থাকবে। একইভাবে রাস্তায় যে পিচ ব্যবহার করা হয়, তা কালো রঙের। রাস্তা নির্মাণকালে জলবায়ুসহিষ্ণু উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব শহর এবং সামগ্রিকভাবে দেশকে উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য সারা দেশে ব্যাপকভাবে বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। বৃক্ষই একমাত্রা প্রাকৃতিক উপাদান, যা বাতাসকে শীতল রাখতে পারে। ঢাকা শহরের যেসব খাল ও জলাধার ভরাট হয়ে গেছে অথবা ভরাট করা হয়েছে, তা পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিতে হবে। ভবিষ্যতে শহরে যাতে কোনো অপরিকল্পিত ভবন নির্মিত হতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। রাজধানী ঢাকা শহরের সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলো মতিঝিল, গুলশান, কাওরান বাজারসহ কয়েকটি এলাকায় বেশি লক্ষ করা যায়। এসব অফিস পর্যায়ক্রমে রাজধানীর সন্নিহিত এলাকায় স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন ছাড়া একটি গাছও যেন কেউ কাটতে না পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। একইভাবে রাজধানী ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সম্ভব হলে হাতিরঝিল লেকের মতো একাধিক দৃষ্টিনন্দন লেক তৈরি করার উদ্যোগ নিতে হবে। হাতিরঝিল লেকের চারদিকে পর্যাপ্তসংখ্যক বৃক্ষ রোপণের ব্যবস্থা করতে হবে।
শহরের পরিবেশ রক্ষায় আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাটন রুজ লুজিয়ানার ইউনিভার্সিটি লেকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। এই লেকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি দর্শনীয় স্থানে পরিণত করা। এই লেকটি বৃষ্টিপাত ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যবহূত হয়। ভারী বৃষ্টির পর পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে। লেকগুলো নদনদীর ওপর প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে এবং সামগ্রিকভাবে নৌযানের সঙ্গ সংযুক্ত রাখা হয়। ইউনিভার্সিটি লেকের নির্মাণকাজ শুরু হয় গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে। প্রথম বারের মতো এটি সংস্কার ও উন্নয়ন ঘটানো হয় ১৯৭০ সালে। এখানে মাছ ধরার ব্যবস্থা আছে। বাচ্চাদের খেলাধুলাসহ পিকনিকের ব্যবস্থা রয়েছে। এই লেকের পানি পার্শ্ববর্তী নদীতে গিয়ে পড়ে। বাটন রুজ লুজিয়ানার ইউনিভার্সিটি লেকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার কাজে সহায়তা করা হয়। লেকের দুই দিকে পরিবেশবান্ধব প্রচুরসংখ্যক বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। এগুলো দৃষ্টিনন্দন এবং জলবায়ুর স্বাভাবিকতা রক্ষায় তাত্পর্যপূর্ণ অবদান রাখছে।