বাড়ির পাশে ময়লার ভাগাড়, মেয়ে বিয়ে দিতে পারছেন না মঞ্জুরা
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
নেত্রকোনা প্রতিনিধি:
ময়লার ভাগাড়ের কারণে একটি এলাকার মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে না! বিষয়টি শুনতে কেমন বিদঘুটে মনে হলেও, এ রকম একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে নেত্রকোণা জেলা সদরে। সেখানে একটি আবাসিক এলাকায় পৌরসভা কর্তৃক ময়লা ফেলার কারণে, ওই এলাকার পরিবেশের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। যে পরিবেশে লোকজন বসবাস করছেন, সেটা রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন বস্তির সঙ্গে তুলনা করলে বেশি বলা হবে না!
ময়লা, দুর্গন্ধ, মশা-মাছি আর রোগ-জীবাণুর আক্রমণে জনজীবন অতিষ্ট হয়ে পড়েছে নেত্রকোণা সদরের রাজুর বাজার এলাকার বাসিন্দাদের। যেটি স্থানীয়দের কাছে ময়লাকান্দা নামে পরিচিত। আবাসিক এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে শহরের অপসারিত ময়লা ফেলছে পৌরসভা। খোলা পরিবেশে ময়লা ফেলায় মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন বাসিন্দারা।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৬ সালে, তৃতীয় নগর পরিচালন ও উন্নতিকরণ প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে এ এলাকার ৩.২ একর জমিতে বর্জ ব্যবস্থাপনার কাজ শুরু করে পৌর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কাজটি সম্পন্ন করতে পারেনি নেত্রকোণা পৌরসভা। তাই প্রতিদিন শহরের প্রায় ৩ থেকে ৪ টন ময়লা বাধ্য হয়েই আবাসিক এলাকায় ফেলতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, অপরিকল্পিতভাবে ময়লা আবর্জনা ফেলায় নানা রকম সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। মশা-মাছি, পোকা-মাকড়, শিয়াল-কুকুরের উপদ্রবেও অতিষ্ঠ তারা। নোংরা পরিবেশে ব্যহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। ময়লার দুর্গন্ধে টিকতে না পেরে এলাকাও ছেড়েছেন অনেকেই। এমনকি বিয়ে ভেঙে যাওয়াসহ আত্মীয়-স্বজনরাও তাদের বাড়িতে আসছেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পাশাপাশি এখানে রয়েছে, বাসস্ট্যান্ড, মসজিদ-মাদ্রাসা, রাইস মিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দাদের একজন মঞ্জুরা খাতুন। ময়লার ভাগাড়ের কারণে মেয়ে বিয়ে দিতে পারছেন না এ নারী।
তিনি বলেন, আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল, এখন এই ময়লার ভাগাড়ের কারণে এখন বন্ধ হয়ে আছে। যেদিকেই বিয়ের কথা বলি তাদের সবার একই বক্তব্য, আপনাদের আশপাশে ময়লা পরিবেশ ভালো না। এখানে বসবাস করা অবস্থায় মেয়ের বিয়ে দিতে পারব কিনা জানি না। এখানে প্রচুর দুর্গন্ধ থাকে সবসময়। হাসপাতালের বর্জ্য এখানে নিয়ে এসে ফেলছে। সে বর্জ্যের মধ্যে ছোট মৃত বাচ্চাও থাকে। সেগুলোকে শিয়াল-কুকুর নিয়ে টানাটানি করে। অনেক সময় আমাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে চলে আসে। এগুলো দেখে বাচ্চারা অনেক ভয় পায়।
তিনি আরও বলেন, কুকুর-বেড়ালের অত্যাচারে আমাদের বাচ্চারা বাসা থেকে ঠিকমতো বের হতেও পারে না। পাশাপাশি সবাই শ্বাসকষ্টে ভোগে। কারণ, এখানে বেশিরভাগ সময়ই আগুন দেওয়া থাকে। ধোয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। আমরা কার কাছে আমাদের দাবি জানাব বলেন? আমাদের তো বলার কোনো জায়গা নেই।
রহিছ মিয়া নামের এক বাসিন্দা জানান, ময়লার গন্ধে এ জায়গা থেকে অনেক পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। দুর্গন্ধ এই পরিমাণ যে এখানে থাকা যায় না, পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষ ভাত খেতে পারে না, সবসময় অনবরত দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। পৌরসভা থেকে বলেছিল এখান থেকে ময়লা সরিয়ে নিয়ে পার্ক করবে। কিন্তু সেটির কোনো খোঁজখবর নেই। এখন কিছুদিন যাবৎ এখানে ময়লা ফেলে না। ভেতরে একটি জায়গা আছে, ওখানে নিয়ে জমা করতেছে। কিন্তু এখানে যে ময়লা আছে সেগুলো সরানোর কোনো উদ্যোগ নেই।
মিনা আক্তার নামে একজন বলেন, বাচ্চারা ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারে না, হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেও ময়লার গন্ধ ফেরানো যায় না। বাচ্চাদের সারা বছরই সর্দি জ্বর হয়, পেটের অসুখ হয়, প্রায় সময় বমি করে। এসব নিয়ে আমরা এখানে বসবাস করছি। আর মশা-মাছির অত্যাচারে বাড়িতে বসবাসের উপায় নাই। বর্ষাকালেও বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমণে ঘরে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ে।
পারুল আক্তার ক্ষোভ নিয়ে বলেন, বাসায় যদি কোনো ধরনের খাবার আনা হয়, মাছ-মাংস হোক আর ফলমূল, সেটা মাছির জন্য রাখা যায় না। রাতের বেলা আমাদের মশারিগুলো মাছিতে কালো হয়ে থাকে। বাসায় দুধ জ্বাল দিতে গেলে মাছি এসে ভনভন করে। তখন দেখা যায় দুধের ওপর মাছি পড়ে দুধটা নষ্ট হয়ে যায়। আমি দুই বছর যাবৎ এই এলাকায় এসেছি, তখন থেকেই এখানে ময়লার দুর্গন্ধ এবং মাছির উৎপাতে জীবন অতিষ্ঠ। মাছির ওষুধ দেই, ঘর পরিষ্কার করি কিন্তু কোনো কাজে আসে না।
পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রাব্বি জানায়, আমরা বর্ষাকালে স্কুলে যেতে পারি না, পানি এবং কাঁদায় ভরে থাকে। পোকামাকড় ভরা থাকে সব জায়গায়। মাছি তো সবসময় থাকেই। পড়াশোনা করতে গেলে নাক-মুখ দিয়ে মাছি ঢুকে যায়। পড়াশোনা করতে খুব কষ্ট হয়। ময়লার মধ্যে অনেক সময় ভাঙা কাঁচ থাকে, যেগুলো দিয়ে প্রায় সময় আমাদের পা কেটে যায়।
আমেনা আক্তার নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, এই জায়গার মধ্যে পৌরসভার ময়লা ফেলে। এখানে বাচ্চাদের সবসময় অসুখ লেগেই থাকে। বয়স্ক লোক যারা আছে, তারাও বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকে। কিন্তু এসব নিয়ে পৌরসভার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের বাসায় কেউ বেড়াতে আসতে চায় না। ধরেন বাড়িতে কেউ বেড়াতে আসলো তাদের খাবার দিলাম, হঠাৎ খাবারের মধ্যে একটা মাছি পড়ে গেল। তখন আর কেউ খাবার খেতে চায় না।
বর্জ্য অপসারণ অবশ্যই আবাসিক এলাকা থেকে নিরাপদ দূরত্বে করা উচিৎ উল্লেখ করে নেত্রকোণা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবু সাঈদ মো. মাববুবুর রহমান বলেন, ময়লার দুর্গন্ধ, মশা-মাছি, শিয়াল-কুকুরের উপদ্রবের পাশাপাশি টাইফয়েড, স্বর্দি-কাশি, পেটের পীড়াসহ নানাবিধ শারিরিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে এখানে মাছি ও শিয়াল-কুকুর অবস্থান করায় বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়িয়ে থাকে।
তিনি আরও বলেন, আবাসিক এলাকা থেকে নিরাপদ দূরত্বে ময়লা থেকে ফেলা উচিত বলে আমি মনে করি।
নেত্রকোণা পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক ওয়াহিদ জানান, আমাদের পৌরসভায় ‘তৃতীয় নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নতিকরণ (সেক্টর) প্রকল্প’ ছিল। সেটি ২০১৬ সাল থেকে নেত্রকোণা জেলায় চলমান ছিল। যেটির মেয়াদ ২০২১ সালে এসে শেষ হয়েছে। আমরা প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা পেয়েছিলাম ল্যান্ড-ফিল বাবদ। সেখানে জেলা প্রশাসন কর্তৃক ৩.২ একর জায়গা ক্রয় করি। জায়গা ক্রয় করে অবকাঠামোর কাজ শুরুর পর আমাদের প্রজেক্টের সময় শেষ হয়ে যায়, তাই আমরা কাজ শেষ করতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু প্রজেক্টের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে, আমরা জায়গাও অধিগ্রহণ করেছি, অনেক কাজও এগিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। প্রজেক্টের শুরুতে বিষয়টা এমন ছিল যে, শহরের যেকোন ধরনের ময়লা হোক না কেন, সেটাকে জৈব সার হিসেবে বের করা। পাশাপাশি রাবার বা পলিথিন জাতীয় জিনিস আলাদা করে রাখা। কিন্তু আমরা সেখানে সফল হতে পারিনি, সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য।