
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বায়ু দূষণের কারণে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বালু কণার আদর্শ মান ২.৫ (পিএম ২.৫)। অথচ বাংলাদেশে প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে বেড়ে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম হয়েছে।
আমাদের দেশে বায়ু ও পরিবেশ নিয়ে প্রায় ২০০টির মতো আইন আছে। কিন্তু এগুলোর প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায় না। বর্তমানে বায়ু দূষণের জন্য নীতিমালা করা হয়েছে। অনেকগুলো প্রোগ্রামও হাতে নেওয়া হয়েছে। দূষণ কমানোর জন্য নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে অনেক ধরনের কার্যক্রম এবং গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও পরিবেশ সুরক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বায়ু দূষণ হলো বায়ুমণ্ডলে এমন কিছু পদার্থের উপস্থিতি যা মানুষ এবং অন্যান্য জীবের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। বায়ু দূষণের কারণে রোগ-ব্যাধি, অ্যালার্জি থেকে শুরু করে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। প্রাণী এবং ফসলের ক্ষতির মতো অন্যান্য জীবন্ত প্রাণী এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের (জলবায়ু পরিবর্তন, ওজোন স্তর ক্ষয়) ক্ষতি করতে পারে।
মানুষের ক্রিয়াকলাপ এবং প্রাকৃতিক ঘটনা উভয়ের কারণে বায়ু দূষণ হতে পারে। গাড়ির কালো ধোয়া, কারখানা থেকে নির্গত ধোয়া, জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কার্বন-মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ধূলিকণা, সালফার-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি কারণে বায়ু দূষণ হতে পারে।
মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। এটি প্রধানত শরীরের শ্বসনতন্ত্র এবং সংবহন তন্ত্রকে বেশি আক্রমণ করে। এমনকি বায়ু দূষণের কারণে হাঁপানি, ক্যান্সার, হৃদরোগ, সিওপিডিসহ ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের মতো অসংক্রামক রোগও বেড়ে যায়। বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগের কারণে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় তার অন্যতম কারণ বায়ু দূষণ।বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগের কারণে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় তার অন্যতম কারণ বায়ু দূষণ।
অতিক্ষুদ্র কণা সহজেই মানুষের চোখ-নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করে রক্তের সাথে মিশে যায়, যা ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, কিডনি লিভারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জটিল অঙ্গকে আক্রান্ত করে থাকে। বায়ু দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য। গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ু দূষণের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
শীতকালে বায়ু দূষণের পরিমাণ যখন বেশি থাকে তখন নিউমোনিয়া ও সিওপিডি রোগী অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এ সময় মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। অ্যাজমা রোগীদের শ্বাসকষ্টও বেড়ে যায়।
বায়ু দূষণের কারণে গর্ভবতী মায়েরা অক্সিজেন কম পান, ফলে কম ওজনের শিশু জন্ম নেয়। বায়ু দূষণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে ফুসফুসে ক্যান্সারও হতে পারে।
বায়ু দূষণের কারণে মানুষ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে যায়, এর ফলে খরচ বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। অর্থনৈতিকভাবে দেশ পিছিয়ে পড়ছে, শ্রমজীবী মানুষ তাদের কর্মঘণ্টা হারিয়ে ফেলছে, এর প্রভাবও পড়ছে অর্থনীতির ওপরে। বায়ু দূষণ বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূষণে উচ্চ রক্তচাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও তামাকের কারণে হওয়া মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
বাংলাদেশে বায়ু দূষণের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মারা যাওয়ার প্রবণতাও সবচেয়ে বেশি। বায়ু দূষণ অনেকভাবে শিশুদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে পুরো শৈশবকাল পর্যন্ত শিশুর ওপর এর প্রভাব বিদ্যমান থাকে। যার প্রভাবে শিশুদের অকাল জন্ম, হাঁপানিসহ শ্বাসতন্ত্র সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়।
বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব—
১) বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস বৃদ্ধি;
২) এলার্জি, কাশি, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়া;
৩) পৃথিবীর তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এসিড বৃষ্টি হচ্ছে;
৪) বাতাসে ঘুরে বেড়ানো দূষিত বায়ু কণা ২.৫ বা পিএম ২.৫ ক্ষুদ্র কণা নিশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে বেশি আক্রান্ত করে ফুসফুসে। তারপর রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে বিশুদ্ধ অক্সিজেন কোষে পৌঁছাতে বাধা দেয়।
৫) গাড়ি ও শিল্প-কলকারখানার গ্যাস নিঃসরণের পাশাপাশি দাবানল ও ধুলো ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক উৎস থেকেও পিএম ২.৫ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
৬) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে মানুষ গড় আয়ুর চেয়ে কম বয়সে মারা যায়। জটিল রোগের মধ্যে রয়েছে ফুসফুসের রোগ ও ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনিসহ বিভিন্ন জটিলতা।
বাংলাদেশে বায়ু দূষণের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মারা যাওয়ার প্রবণতাও সবচেয়ে বেশি। বায়ু দূষণ অনেকভাবে শিশুদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে পুরো শৈশবকাল পর্যন্ত শিশুর ওপর এর প্রভাব বিদ্যমান থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পাঁচ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত দূষণকারী কণার উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য ধরা হয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অনেক ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র এলাকায় দূষণের মাত্রা থাকে ২০ থেকে ২৫ গুণ বেশি।
সঠিক পদক্ষেপ ও নীতির মাধ্যমে বায়ু দূষণ রোধ করা সম্ভব। বায়ু দূষণ প্রতিরোধের উপায় জানতে হবে এবং মানতে হবে। উপায়গুলো হলো—
১। বায়ু দূষণ উৎসের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা;
২। যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ : যানবাহন থেকে নির্গত কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড নিয়ন্ত্রণ;
৩। কল-কারখানার ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ : উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে;
৪। বিকল্প জ্বালানি প্রয়োগ : জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ হ্রাস করে সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে;
৫। পরিত্যক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : পরিত্যক্ত বর্জ্য না পুড়িয়ে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা যায়। অথবা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়;
৬। কীটনাশক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা;
৭। অঞ্চল ভাগ : নগরে বসতি, শিল্প-কারখানা পরিকল্পিতভাবে স্থাপন করতে হবে;
৮। বৃক্ষরোপণ : সবচেয়ে উত্তম পন্থা এটাই;
বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। গাছ থেকে আমরা অক্সিজেন পাই। সেই অক্সিজেন আমরা শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছেড়ে দিই। কার্বন ডাই-অক্সাইড উদ্ভিদ গ্রহণ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি করে। এভাবেই বাতাসে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ভারসাম্য রক্ষা হয়।
আমরা যদি গাছ কেটে ফেলি তাহলে বাতাসে বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে যাবে যাতে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হবে, দূষিত পদার্থের পরিমাণ বাতাসে বেড়ে যাবে। আমরা শ্বাসের মাধ্যমে যখন দূষিত পদার্থ নিচ্ছি তখন আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ আক্রান্ত হচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগের মধ্যে মানুষ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
ডা. আয়শা আক্তার ।। উপ-পরিচালক, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতাল, ঢাকা