বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ-অগ্নিসংযোগ: হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন দগ্ধরা, অসহায় স্বজনরা

প্রকাশিত: ১০:১৭ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৮, ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বিএনপি-জামায়াতের দ্বিতীয় দফায় ডাকা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের প্রথম দিনে প্রতিদিনের মতোই ভোর সকালে মেরুল বাড্ডার ভাড়া বাসা থেকে কাজের জন্য বের হয়েছিলেন বাসচালক সবুজ। বাসের মালিক তাকে রাতেই নিষেধ করেছিলেন, সড়কে ঝামেলা দেখলে বাস নিয়ে এদিন বের না হতে। মালিকের কথা আমলে নিয়ে সতর্কও ছিলেন সবুজ। তবু বিপদ তার পিছু ছাড়লো না। ডেমরা এলাকার মেরাদিয়ায় বাস রাখার গ্যারেজের গেটের কাছে এলে বহন করা বাসটি তাকে নামানোর জন্য ধীরগতিতে চলে। এ সময় সবুজ বাস থেকে নামার জন্য সিঁড়িতে পা বাড়াতেই দুর্বৃত্তদের আক্রমণের শিকার হন। চলন্ত গাড়িতে দরজার সামনে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করলে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে যায়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালের এইচডিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।

মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিন বার্ন ইনস্টিটিউটের ওই ওয়ার্ডের পাশে গেলে দেখা যায়, দগ্ধ সবুজের স্ত্রী রাশেদা বেগম অসহায় হয়ে ছোটাছুটি করছেন। স্বামীর এই দুরবস্থায় কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। স্বজনদের ফোন দিচ্ছেন আর কান্না করছেন।

তিনি বলেন, আমার স্বামী প্রতিদিনই সকাল ৬টার মধ্যে গাড়ির উদ্দেশে বের হন। ওই দিনও সকাল সকাল বের হয়েছিলেন গ্যারেজ থেকে গাড়ি আনতে। তিনি গাড়ির কাছে যেতেই পারেনি। ৭টার দিকে আমার কাছে ফোন আসে আমার স্বামী আগুনে পুড়ে গেছে। খবর পেয়ে আমি হাসপাতালে ছুটে যাই।

রাশেদা বেগম বলেন, আমার স্বামী রমজান নামের বাসের চালক। আমার বিয়ে হয়েছে এক যুগ। বিয়ের পর থেকে দেখছি গাড়িতে কাজ করেন। একসময় গাড়ি চালাতে শুরু করেন। এটাই আমাদের একমাত্র আয়ের পথ। আমাদের দুই জন ছেলেমেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে স্বপ্না আক্তার লামিয়া একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। ছোট ছেলের বয়স ৬ বছর। ছেলেটি বারবার বাবার কাছে যেতে চায়। নিয়ে যেতে পারি না। আমার শ্বশুরও অসুস্থ। দুইবার স্ট্রোক করেছেন। শাশুড়ি বেঁচে নেই। আমি ছাড়া আমার স্বামীর পাশে আর কেউ নেই। তার কিছু হলে আমি সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাবো।

স্বামীর বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, যে লোকটি বোমা মেরেছে তার মুখে মাস্ক পরা ছিল। আমার স্বামীকে টার্গেট করেই দরজার মারে। তিনি একাই আহত হয়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলে জানান, বাসে অনেকেই ছিল। তিনি দরজার পাশে থাকায় বেশি আহত হয়েছেন। তখন অন্যদের বিষয়ে জানতে পারেননি।

এর আগে গত ২৯ অক্টোবর ভোররাত ৩টার দিকে রাজধানীর ডেমরা এলাকায় পার্কিংয়ে থাকা অসীম পরিবহন নামে একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে দগ্ধ হয়ে বাসে ঘুমিয়ে থাকা মো. নাঈম (২২) নামে একজন বাসচালকের সহযোগীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় রবি নামে বাসটির আরেক সহকারী আহত হয়। রবির বাবা-মার দাবি তার বয়স ১৮, তবে হাসপাতালের খাতায় লেখা ২৫ বছর। তারা দুই জনই ওই বাসে ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘটনার পর দগ্ধ রবিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে রবিও আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) দুপুরে বার্ন ইনস্টিটিউটের ষষ্ঠ তলায় হাসপাতাল ফ্লোরে রবির বাবা মো. হযরত আলী, মা ইয়াসমিন বেগম ও দুই মেয়েকে আহাজারি করতে দেখা গেছে।

ওই সময় রবির বাবা মো. হযরত আলী বলেন, কয়েক মাস আগে গাড়িতে কাজ করলেও মাঝখানে গাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়েছিল। দুই মাস হলো গাজীপুরে একটি কার্টন কারখানায় কাজ নিয়েছিল, সেখানে থেকে কাজ ছেড়ে চলে আসে। পরবর্তী সময়ে আবারও বাসের কাজে ফিরে যায়। দ্বিতীয়বার গাড়িতে গেছে ৫ থেকে ৭ দিন হবে। এর মধ্যেই আমার ছেলের আজ এই অবস্থা। তিনি বলেন, গাড়ি চালানো শেষ হলে রাতে সবসময় সে গাড়িতে থাকতো। সেদিনও গাড়িতেই ছিল। ছেলের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, সে ঘুমে ছিল। আগুনের তাপ, শব্দ পেয়ে গাড়ির গ্লাস ভেঙে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যায়। তারপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, আমি রিকশা চালাই, দুইবার স্ট্রোক করেছি। এখন আর কাজ করতে পারি না। ছেলে কাজ ধরছিল। এখন সেটাও থেমে গেছে। আমার ছেলে কোনও দল করে না, আমরা রাজনীতি বুঝি না। আমাদের কোনও অর্থ-সম্পদ নাই। ২০ বছর ধরে ডেমরা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকি। আমার কেন এ বিপদ এলো? আমরা এখন চলবো কীভাবে? দুই মেয়ে আছে সংসারে। আল্লাহ যেন ছেলেকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়।

এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, গত ২৯ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল চলাকালীন দুই জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন। তাদের একজন রবি। তার শরীরের ১৭ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তার শ্বাসনালি দগ্ধ হয়েছে। বর্তমানে তাকে এইচডিইউ ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। তবে রবি আশঙ্কামুক্ত নন।

একই সময়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ভর্তি হন শাখাওয়াত হোসেন। তিনিও বর্তমানে এইচডিইউ ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। তবে তিনি আশঙ্কামুক্ত। এছাড়া সবুজ দ্বিতীয় দফা অবরোধের প্রথম দিন দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে আসেন। তার শরীরের ২৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তার বর্তমান অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিনিও এইচডিইউ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।

হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে দগ্ধ হয়ে এই তিন জনই বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন বলে জানান তরিকুল ইসলাম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়ারি বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডেমরা জোন) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, মধ্য রাতে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় ডেমরা থানায় মামলা হয়েছে। যারা বাসে আগুন দিয়েছে আমরা তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। আশপাশের কিছু সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করে আমরা পর্যালোচনা করছি। দোষীদের খুঁজে বের করতে আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।

এদিকে দ্বিতীয় দফা অবরোধের প্রথম দিনে রাজধানীর মেরাদিয়ায় বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের বিষয়ে মতিঝিল বিভাগের খিলগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ নূরুল আমীন বলেন, জড়িতদের এখনও সুস্পষ্টভাবে আমরা শনাক্ত করতে পারেনি। ঘটনার পর লোকটি বাড্ডার দিকে চলে যেতে সিসিটিভিতে দেখা গেছে, তবে সেটি স্পষ্ট নয়। আমরা তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। এ ঘটনায় কি সবুজ একাই আহত হয়েছিলেন, বাসে তো আরও লোকজন ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সবুজ ছাড়া আরও দুই জন আহত হয়েছে। তবে তারা গুরুতর নয়। সামান্য আঘাত পেয়েছে।

এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, নির্বাচনের আগে একপক্ষ অপর পক্ষকে দোষ দেওয়া আমাদের দেশে নতুন কিছু না। একটি কথা আছে, আইন হলো গরিবদের শাসন করার জন্য, আইনকে শাসন করে ধনীরা। যেকোনও দলই করুক গণপরিবহনে কেন হামলা করবে? গণপরিবহনে তো গুলশানের কেউ চড়ে না। গণপরিবহনে চড়ে সাধারণ মানুষ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত লোকজন। একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানে ওই রোডে একটি গাড়ি কমে গেলো। এই জ্ঞানটুকু থাকা দরকার। কোনও দেশেই দেখবেন না যে ট্রেনের ওপর ড্রিল মারে। আমাদের দেশে মারে। এ ধরনের মন-মানসিকতা নিয়ে তো রাজনীতি করা সম্ভব না। এ কাজটা যে শুধু বিরোধী দল করে তা নয়, যারা ক্ষমতায় থাকে না, তারাই করে। সব দলেরই লক্ষ্য এক, ক্ষমতায় যাওয়া। মুক্তবাজারের অর্থনীতি লুটপাট করা।

হরতালের পর ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ঘোষণা দেয় বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এরপর ৩ ও ৪ নভেম্বর বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই অবরোধ শেষ হলে ৭ নভেম্বর বিরতি দিয়ে ৮ নভেম্বর থেকে আরও ৪৮ ঘণ্টা টানা অবরোধ কর্মসূচি চলছে।