জেলা প্রতিনিধি, নীলফামারী
গাঢ় গোলাপী বা লালচে রংয়ের সবজি বিটরুট। শীতকালে উৎপাদন বেশি হলেও বর্তমানে সবসময়ই এ সবজির দেখা মেলে। বিভিন্ন পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন এ সবজিটিকে সুপারফুডও বলা হয়ে থাকে। নীলফামারীর যুবক আবু সুফি আহমেদ প্রথমবারের মতো চাষ করছেন এ সবজিটি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ালেখা শেষে থাইল্যান্ডের বিটরুট চাষ করে এলাকার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি।এছাড়া নিজেই তৈরি করেছেন ব্যাক টু নেচার (বিএনএল) নামে একটি কোম্পানি। সেই কোম্পানির মাধ্যমে নিজের চাষাবাদের পণ্য দেশের বিভিন্ন সুপার শপে বিক্রি করছেন তিনি।
নীলফামারী সদর উপজেলার পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের কাছারীপাড়া গ্রামে বাসিন্দা আব্দুল গফুরের ছেলে আবু সুফি আহমেদ। রংপুরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ালেখা শেষ করেছেন। তার বাবা পেশায় কৃষক হওয়ায় কৃষি পেশার ওপর রয়েছে সম্মান ও ভালো লাগা। আর এই ভালো লাগা থেকে প্রথমবারের মতো ৫২ শতক জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে উচ্চ ফলনশীল বিটরুট চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। এদিকে আগামী মৌসুমে বিটরুট চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন স্থানীয় চাষিরা।
বিটরুটের গাছ দেখতে অনেকটা পালং শাকের মতো হলেও রঙে ভিন্নতা আছে। এ সবজির ভেতরের রং গাঢ় লালচে বেগুনি। বীজ রোপণের দুই মাস পর মাটির নিচে হয় এ সবজি। প্রতিটির ওজন হয় গড়ে ২০০ গ্রাম থেকে আধা কেজি পর্যন্ত। সালাদ, সবজি ও জুসের জন্য অভিজাত শ্রেণির হোটেলে এ সবজির বেশ কদর রয়েছে। পুষ্টিকর খাবার হিসেবেও এটি পরিচিত। উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের মহাঔষুধ হিসেবেও ফলটি কার্যকর। দামও ভালো। গ্রামের বাজারেই এ সবজির কেজি প্রতি দাম ৩০০ টাকার কাছাকাছি। বিট রুট চাষে অবশ্য খরচও বেশি। এক বিঘা জমিতে খরচ হয় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকার মতো। তবে দাম বেশি হওয়ায় খরচ বাদে এক লাখ টাকার মতো আয় করা সম্ভব।
ডিসেম্বরের শুরুতে বিটরুট রোপণ করার উপযুক্ত সময় এবং তা উঠতে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ দিন সময় লাগে। মার্চের শেষে ফসলটি সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করার উপযুক্ত সময়। ফসলটি ব্যাপকভাবে উৎপাদন করতে পারলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। যুবকদের কৃষিতে আগ্রহী হলে কৃষি শিল্পের নতুন দিগন্ত তৈরি হবে।
ক্ষেত থেকে বিটরুট তুলে বাড়ির উঠানে কুচিকুচি করে কাটতে ব্যস্ত দেখা গেছে তরুণ উদ্দ্যোক্তা সুফিকে। তার কাজে সহযোগিতা করছেন পরিবারের লোকজনও। কুচিকুচি করে কাটার পর তা শুকানো হচ্ছে বাড়ির ছাদে। এরপর তার হিট মেশিনের মাধ্যমে আরও শুকানোর প্রক্রিয়া শেষে পাউডার করা হচ্ছে। তা ছোট ছোট জারের চলে করে যাচ্ছে ক্রেতার হাতে। প্রতিদিন এক থেকে দুই কেজি পাউডার বিক্রি করেন সুফি। আধা কেজির পাউডারের দাম এক হাজার টাকা আর ২৫০ গ্রাম পাউডারের দাম ৫০০ টাকা।
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করলেও আবু সুফি আহমেদের কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন। কৃষির পাশাপাশি গাভি, হাঁস ও পুকুরে মাছ চাষ করছেন তিনি। তাই এবার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের প্রস্তাবে জেলায় প্রথম বিটরুট চাষ করছেন, তেমন যত্ন ছাড়াই ভালো ফলন হয়েছে। আগামীতে আরও বেশি জমিতে বিটরুটের আবাদ করবেন তিনি। তবে বিটরুট চাষের শুরুতে বিষয়টি ভালো ভাবে নেননি সুফির প্রতিবেশীরা। বিটরুট চাষ নিয়ে হাসাহাসি করেছেন অনেকেই।
স্থানীয় কৃষক এজাজুল হক বলেন, উনি চাষ করেছেন উনি যদি লাভবান হতে পারে তাহলে আশপাশে যারা আছি আমরাও চাষ করার চেষ্টা করব।একই এলাকার হাফিজুল ইসলাম বলেন, আমি এই ফসলটা কখনো দেখিনি নতুন করে দেখলাম। আগামীতে আমিও আবাদ করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সুফির মা লাইলী বেগম বলেন, আমাদের গ্রামের মানুষ অনেক উপহাস করতো। আমি আশা করি বিটরুট জমিতে আবাদ করে আমার ছেলে যেন লাভবান হতে পারে। আগামীতে আমার ছেলের মতো কৃষক যেন জমিতে আবাদ করে সবাই যেন লাভবান হতে পারে।
সুফির বাবা আব্দুল গফুর বলেন, এটা আমার এলাকার লোকজনকে দেখাইতেছি যে আপনারা এটা চাষ করেন লাভবান হবেন। এটা ঔষধ জাতীয় জিনিস। আপনারা বিক্রি করতে না পারলে আমার ছেলেকে দেবেন বিক্রি করে দেবে।
আবু সুফি আহমেদ বলেন, আমি পড়ালেখা শেষ করে বিভিন্ন ধরনের অর্গানিক প্রোডাক্ট নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেছি। সেই সুবাধে আমার অর্গানিক প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা। সেজন্য নীলফামারীতে তৈরি করেছি ব্যাক টু নেচার (বিএনএল) নামে একটি কোম্পানি। বিটরুটের মধ্যে এন্টি-এজিং উপাদন রয়েছে, যেটা সৌন্দর্য্যকে ধরে রাখে। ওসব কোম্পানি আমাকে এটা চাষের বিষয়ে পরামর্শ দিল সেখান থেকে আমি ইচ্ছা পোষণ করে আমার ৫১ শতক জমিতে বিটরুট চাষের সিদ্ধান্ত নিলাম। তেমন যত্ন ছাড়াই ভালো ফলন হয়েছে। আগামীতে আরও বেশি জমিতে বিটরুটের আবাদ করব।
তিনি আরও বলেন, এক কেজি বীজ ও সার মিলিয়ে ছয় হাজার টাকা, লেবার ও পানি খরচ ৯ হাজার টাকা পড়ে। সব মিলিয়ে বিঘা প্রতি ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বিটরুট চাষে। বেলে, দোআঁশ জাতীয় উর্বর মাটিতে চাষ করলে সার কম লাগে। এ গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় খরচ অনেকটাই কম। বীজ রোপণের চার মাসের মাথায় ক্ষেত থেকে বিটরুট উঠানো শুরু করেছি। আমার কোম্পানির মাধ্যমে কাঁচা এবং পাউডার করেও বিক্রি করছি।
কৃষি বিভাগ জানায়, বিটরুট চাষের জন্য উপযুক্ত নীলফামারীর মাটি ও আবহাওয়া। বিটরুট চাষি আবু সুফিকে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নিয়মিত পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আগামীতে বিট চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে।
নীলফামারী সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আতিক আহমেদ বলেন, নীলফামারীতে প্রথম বিটরুট চাষ করেছেন আবু সুফি আহমেদ। আমরা সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শন করেছি, ফলন সন্তোষজনক। বিটে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন, আয়রন, ক্যালসিয়াম, কপার ও অন্যান পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। এছাড়া এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ক্যানসার, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাকে নিয়মিত পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।