বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের তথ্যে অভিযান, মেলেনি কানাকড়িও!
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পপতি মাহবুবুল আলম। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের তথ্য পেয়ে গভীর রাতে তার চট্টগ্রামের বাসায় অভিযান চালায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রায় আড়াই ঘণ্টা অভিযান শেষে কাগজে-কলমে তারা জানায়, বাসাটিতে কানাকড়িও মেলেনি। যদিও সরেজমিনে সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) দিবাগত মধ্যরাত ৩টার দিকে অভিযান শেষে দুদক ও র্যাব কর্মকর্তাদের অনেকটা হাসিমুখে বাসা থেকে বের হতে দেখা যায়।
জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানার সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় বাসাটির অবস্থান। আবাসিকের ১৭৫/১৭৬ নম্বর জামিলাস কটেজ নামের বাসাটি সোমবার দিবাগত রাত ১২টার পরে অভিযান শুরু হয়। এর আগে বাসাটির আশেপাশের এলাকা ঘিরে রাখেন র্যাব কর্মকর্তারা। সেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি তল্লাশির সময় এই প্রতিবেদকসহ উপস্থিত ৩টি গণমাধ্যমের কর্মীদের কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
এদিকে, প্রায় আড়াই ঘণ্টার অভিযান শেষে কানাকড়িও উদ্ধার না হওয়ায় নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। কারণ এত বড় অভিযান দেশের শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থাদের যেমন জানানো হয়নি, তেমনি পুলিশের কাউকে জানানো হয়নি। যে সূত্রের ভিত্তিতে র্যাব আর দুদক একসঙ্গে অভিযান চালায়, একই সূত্র বিষয়টি একাধিক সংস্থাকেও জানিয়েছিল। একারণে বাসাটি আগে থেকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে ছিল।
অভিযানের তল্লাশি প্রতিবেদন এসেছে হাতে। এতে দেখা যায়, মূল অভিযান পরিচালনা করে দুদক। এতে সহায়তাকারী হিসেবে র্যাবের বিপুল সংখ্যক ফোর্স উপস্থিত ছিলেন। একই সঙ্গে ছিলেন ইউসুফ হাসান নামে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।
তল্লাশি প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ১৫ মিনিটে অভিযান শুরু হয় এবং শেষ হয় রাত ২টা ৪০ মিনিটে। অভিযানে তল্লাশিকালে কোনো মালামাল বা আলামত পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনটিতে। একারণে কোনো মালামাল বা আলামতও হেফাজতে নেওয়া হয়নি।
তল্লাশি প্রতিবেদনটিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পাশাপাশি র্যাবের টিমের পক্ষে একজন সই করেন। এছাড়া মাহবুবুলের পরিবারের পক্ষে তার এক মেয়ে মেহেরুবা মাহবুব এবং দুই মেয়ের স্বামী তাহমিদুর রহমান ও তাসনিম মাহমুদ সই করেন।
জানা যায়, ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম। গত বছরের ১৪ আগস্ট ২০২৩-২৫ মেয়াদে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর ৯ সেপ্টেম্বর তিনি ই-মেইলের মাধ্যমে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি হওয়ার আগে তিনি চট্টগ্রাম চেম্বারেরও সভাপতি ছিলেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন এই ব্যবসায়ী নেতা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ফোরামের সভাপতি ছিলেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, মাহবুবুল আলম ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হন ১৯৮৩ সালে। গত প্রায় চার দশকে কমোডিটি ট্রেডিং থেকে শুরু করে ব্যাংক ও আর্থিক পরিষেবা, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন তিনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলটির পক্ষ থেকে প্রায় পুরো দেশের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও তার বাসায় বিপুল পরিমাণ ডলার মজুত থাকত। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ডলার সংকটের সময়ও তার হাতে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ছিল বলে তথ্য রয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর আগে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন মাহবুবুল আলম। আন্দোলন বানচালে এই অর্থ ব্যয় করা হয়। জুলাইয়ের শেষের দিকে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের নির্দেশে মাহবুবুলের বাসাটিতে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রা মজুত করা হয়।
একটি সূত্রের তথ্যমতে, অন্তত ৩ হাজার টাকা মূল্যের দেশি-বিদেশি মুদ্রার মজুত ছিল বাসাটিতে। সূত্রটি আগেই একাধিক বাহিনীকে অভিযান পরিচালনার জন্য তাগাদা দিতে থাকে। সবশেষ র্যাব এবং দুদক অভিযানে রাজি হয়।
যদিও সূত্রের একজন এই প্রতিবেদককে বলেন, হয় অভিযান শুরুর আগে র্যাব-দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব দেশি-বিদেশি মুদ্রা সরিয়ে ফেলেছেন। অথবা অভিযানের সময় বাসার পেছন দিয়ে মুদ্রাগুলো বের করা হয়। না হয়, অনৈতিক কোনো সুবিধা পেয়ে দুদক-র্যাব কর্মকর্তারা ম্যানেজ হয়ে গেছেন। কারণ তাদের অভিযান করতে অনুরোধ করা হয়েছিল দিন-দুপুরে। কিন্তু এটা না করে তারা অভিযান পরিচালনা করে গভীর রাতে। অভিযানের সময় কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে অবহিত করা হয়নি। সবমিলিয়ে কানাকড়িও না পাওয়া নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠেছে।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া দুদকের সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেনকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফ হাসান বলেন, মূল অভিযান পরিচালনা করে দুদক। তারা র্যাব ফোর্সের সহায়তা নেন। পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের সহায়তা চান। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি গিয়েছিলাম। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের তথ্যে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে এরকম কিছু পাওয়া যায়নি। এর বাইরে অভিযান নিয়ে প্রশ্ন থাকলে দুদক বা র্যাবকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
অভিযানে র্যাবের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রামের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম। তিনি বলেন, বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের তথ্য ছিল দুদকের। আমরা তাদের সহায়তা করি। তারা জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি আমাদের সহায়তা চায়। আমরা ফোর্স দিয়ে সহযোগিতা করি। কিন্তু অভিযানে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাতকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে সরেজমিনে সোমবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে অভিযানের পরপরই বাসাটির গেটের সামনে এক নারী ও দুজন পুরুষ এবং একজন সিকিউরিটি গার্ডকে দেখা যায়। গণমাধ্যমকর্মী জেনে তারা কেউ নিজেদের পরিচয় দেননি। এছাড়া অভিযানের বিষয়ে কোনো মন্তব্যও করেননি। শুধু একজন পুরুষ বলেন ‘আপনারা তো দেখেছেন বাসাটিতে কিছু পাওয়া যায়নি’।
তবে গলিতে থাকা কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড জানান, যে বাসাটিতে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে সেটির পেছনেও দরজা রয়েছে। যেখান দিয়ে টাকা সরানোর সুযোগ রয়েছে। এরকম কিছু দেখেছেন কি না জানতে চাইলে তারা জানান, অভিযানে থাকা র্যাব ও দুদকের কর্মকর্তারা তাদের বাসাটির পেছনের দিকে যেতে দেননি।
জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলাইমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযানের বিষয়ে আমাদেরকে জানানো হয়নি। এজন্য আমরা যাইনি।
অভিযানের বিষয়ে জানতে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলমের মোবাইলে ফোনে কল করা হয়। অপরপ্রান্তে কলটি রিসিভ করেন একজন নারী। তিনি নিজেকে মাহবুবুলের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, বেশ কয়েকদিন ধরে তারা বাসাটিতে থাকেন না। বর্তমানে তাদের মেয়ে এবং মেয়ের স্বামীসহ কয়েকজন নিকটাত্মীয় বাসাটিতে রয়েছেন। বাসায় তেমন কিছু নেই। দুদক ও র্যাব টাকা মজুতের তথ্য পেয়ে আসছিল। কিন্তু কিছু না পাওয়ায় অভিযান শেষে তারা হাসিমুখে ফিরে গেছেন।