বিশৃঙ্খল সড়ক: শুধু আইনের সংশোধনই যথেষ্ট নয়

প্রকাশিত: ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ, মে ১৫, ২০২৪

ড. মো. হাদিউজ্জামানঃ 

প্রতি বছরই আমাদের দেশে একটি চিত্র দেখা যায় তা হলো, যে কোনো ধর্মীয় উত্সব বা পালাপার্বণের আগে-পরে হঠাত্ করে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। এ সময় যাত্রীর চাপ বহুগুণ বাড়লেও সেই তুলনায় গণপরিবহনের বাড়ে না। ফলে চাহিদা-জোগানের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৫২ শতাংশই জোগান দেয় ঢাকা শহর। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা এসব শ্রমিক বা চাকরিজীবী মানুষ চাইলেও বছরের যে কোনো সময় গ্রামের বাড়ি যেতে পারেন না। তাই তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বা জাতীয় উত্সবের সময় ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ঈদযাত্রায় প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যায়। আবার, ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার দু-এক দিন আগে পোশাক ও শিল্প-কলকারখানায় একসঙ্গে ছুটি ঘোষণা করা হলে এই সংখ্যা বেড়ে ৪০ লাখে উন্নীত হয়। এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে পরিবহনের ক্ষেত্রে গণপরিবহন ব্যবস্থায় ব্যাপক সংকট তৈরি হয়।

ঈদের সময় গণপরিবহনের সংকটকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের অনিয়ম-অনাচার শুরু হয়। দেখা দেয় ভাড়া নৈরাজ্য। ঘরমুখী মানুষ চায় যে কোনো মূল্যেই হোক গ্রামে থাকা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিলিত হবে। সাধারণ মানুষের এই প্রবণতা বা আকাঙ্ক্ষাকে জিম্মি করে এ সময় ভাড়া বাড়িয়ে ফায়দা লুটে নেন কিছু অসাধু পরিবহন ব্যবসায়ী। আবার যাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই, সেই সব নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে উঠে বাড়িতে যান। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ঈদ-যাত্রার কারণেও এ সময় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ে। আহত-নিহতের সংখ্যাও বাড়ে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, আমরা ঈদ যাত্রাকালীন চাহিদামতো গণপরিবহনের জোগান বা সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছি না।

এ বছরও ঈদুল ফিতরের আগে-পরের কয়েক দিন প্রচুরসংখ্যক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে অনেক মানুষ আহত ও নিহত হয়েছে। এ সময় পরিবহনসংকটকে উপজীব্য করে কিছু বাসমালিক তাদের পুরোনো এবং চলাচলের প্রায় অযোগ্য বাসগুলো কিছুটা সংস্কার ও রং করে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। এসব ফিটনেসবিহীন গাড়িই বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের ব্যক্তিগত এবং গণপরিবহনসহ যে পরিমাণে যানবাহন আছে, তা প্রতিদিন গড়ে ২০ লাখ মানুষ ঢাকার বাইরে পরিবহনের সক্ষমতা রাখে। প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ মানুষ পরিবহনের ক্ষমতা থাকলেও অতিরিক্ত ১০ লাখ মানুষের ঢাকা ছাড়ার কোনো ধরনের বিকল্প উপায় থাকে না। তাই তারা অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় শামিল হয়। পাশাপাশি ঢাকা শহরে মোটরসাইকেল এখন অনেকটাই মিনি গণপরিবহনে রূপ নিয়েছে। গণপরিবহনের সংকট এবং ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে দূরপাল্লার যাত্রায় মোটরসাইকেলের ব্যবহার বেড়েছে এবং একই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। যে যানবাহনগুলো সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, তার ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল। এটা প্রমাণ করে যে, দীর্ঘ যাত্রায় চালকের অনভিজ্ঞতা, অদক্ষতা এবং মোটরসাইকেল উপযোগী সড়ক অবকাঠামো না থাকায় মোটরসাইকেল যাত্রা সাধারণ গণপরিবহনের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

আমাদের সড়ক অবকাঠামো ব্যাপক উন্নত হলেও সড়ক ব্যবস্থাপনা এখনো দুর্বল রয়ে গেছে, যা ঈদের সময় আরো বেশি বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। বেশি ট্রিপ দেওয়ার লক্ষ্যে অনেক পরিবহন মালিক ও চালকেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তারা মনে করেন, যত বেশি ট্রিপ, তত বেশি আয়। এই বিবেচনায় তারা চালকদের বিশ্রাম এবং যাত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি হালকাভাবে নেন। পাশাপাশি, ভারী যানবাহনের জন্য নির্ধারিত সড়ক লেন না থাকায় হালকা যানবাহনসমূহ মাত্রাতিরিক্ত ওভারটেক করে দুর্ঘটনায় পড়ে। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো রাস্তায় চলতে গিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলো স্বল্প সময়ে মেরামত করা গেলেও এমন কোনো আলাদিনের চেরাগ নাই, যা দিয়ে একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ চালক রাতারাতি তৈরি করা যেতে পারে। একজন চালক যদি দক্ষ হন, তাহলে তিনি কখনোই আনফিট গাড়ি চালানোর ঝুঁকি নেবেন না। ঈদের আগে রাস্তায় যেসব গাড়ি চলাচল করে, তার একটি অংশ দূরপাল্লায় চলাচলের অনুপযুক্ত। এই আনফিট পরিবহন ও আনফিট চালকদের কারণে ফিট পরিবহন ও চালকেরা দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়ে যান। আইন প্রয়োগকারী এবং পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো বরাবরই হুঁশিয়ারি দেন, আনফিট যানবাহন সড়কে নামতে দেওয়া হবে না। কিন্তু সেই হুঁশিয়ারি বাস্তবায়নের জন্য তাদের কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার যদি সদিচ্ছা থাকত, তাহলে তারা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরের ওয়ার্কশপগুলোতে গিয়ে অভিযান চালাত, যাতে করে সেখান থেকেই ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো রং করে বা কিছুটা সংস্কারের মাধ্যমে রাস্তায় নামাতে না পারে। কারণ হাজার হাজার যানবাহন রাস্তায় নেমে যাওয়ার পর কোনটি ভালো যানবাহন আর কোনটি খারাপ এবং ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন, তা হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশের কাছে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। কাজেই ঈদের আগে যাতে চলাচলের অনুপযোগী কোনো যানবাহন রাস্তায় নামতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এটা নিশ্চিত করা খুব একটা কঠিন কিছু নয়। শুধু প্রয়োজন হলো আমাদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা।

আমাদের দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সামরিক বাহিনীর পরিবহন পুলে বিপুলসংখ্যক বাস-মিনিবাস রয়েছে। এই পরিবহনগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, যার চালকেরাও দক্ষ এবং অভিজ্ঞ হয়ে থাকেন। এই পরিবহন পুল থেকে ঈদের আগে ও পরে স্বল্প সময়ের জন্য এসব গাড়ি গণপরিবহনে যুক্ত করা গেলে খুব সহজেই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হতে পারে। এ ধরনের নজির ইন্দোনেশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশে দেখা যায়। অর্থাত্, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘দলবদ্ধভাবে’ ঢাকা থেকে যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা করা সম্ভব। ঈদের অন্তত দুই মাস আগে থেকে এই প্রোগ্রামে কারা কারা যুক্ত হবে এবং তাদের গন্তব্যসংক্রান্ত তথ্যগুলো সঠিক নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে। এভাবে মানুষ দলবদ্ধভাবে ঢাকা থেকে পরিবহনের ব্যবস্থা করতে পারলে ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা অন্তত ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব হবে। কারণ গণপরিবহনের জোগান দেওয়া গেলে দূরপাল্লায় আনফিট বাস, মোটরসাইকেলসহ বাস-ট্রাক ও ট্রেনের ছাদে ঝুঁকি নিয়ে চলাচলে অনেকেই নিরুত্সাহিত হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তাবায়নের জন্য দরকার সদিচ্ছা, কমিটমেন্ট এবং সঠিক পলিসি। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে জনগণের ভোগান্তি কমলেও যারা লক্কড়ঝক্কড় বাস চালিয়ে ঈদের সময় অর্থ উপার্জন করেন, তারা মনঃক্ষুণ্ন হতে পারেন। এমনকি তারা এই উদ্যোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেন। বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ঝড় আসবে, কিন্তু সেই ঝড় দেখে ভয় পেলে চলবে না। চাপে পড়ে নীতিনির্ধারকদের অসহায়ত্ব স্বীকার করা যাবে না। আমরা যদি এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে ঈদযাত্রা অনেকটাই নিরাপদ, স্বস্তিদায়ক এবং আরামদায়ক হতে পারে।

প্রতি বছর সড়কে গড়ে প্রায় ৫ হাজার মানুষ নিহত হচ্ছে। তথ্য অনুযায়ী আরো প্রায় ১২-১৪ হাজার মানুষ প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ কমপক্ষে ৪০ হাজার কোটি টাকা। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার হার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনব। কিন্তু সেই কমিটমেন্ট আমরা পূরণ করতে পারিনি। সময় বাড়ানো হয়েছে। এখন ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমানোর জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু আমরা দেখছি, সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী।

দুর্ঘটনা রোধের জন্য সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ আছে, শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য একটি গোষ্ঠীর চাপের মুখে আইনের অনেকগুলো ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে। যে স্পিরিট নিয়ে আইনটি তৈরি করা শুরু হয়েছিল, তা অনেকটাই দুর্বল হয়ে একটি সমঝোতার দলিলে পরিণত হয়েছে। তাই সংশোধিত সড়ক পরিবহন আইন সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে কতটুকু সহায়ক হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বর্তমান সরকার ধারাবাহিক সরকার। সরকার যদি আন্তরিক হন, তাহলে পরিবহন সেক্টরে যে সিন্ডিকেট রয়েছে, তা ভেঙে দেওয়া সম্ভব। সরকার নানা ধরনের উন্নয়নকাজ করছে, প্রশংসিত হচ্ছে। এখন সরকার যদি সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অরাজকতা দূর করতে পারে, তাহলে আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি।

লেখক :প্রফেসর, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, বুয়েট

অনুলিখন :আফরিন আক্তার