জেলা প্রতিনিধি,বগুড়াঃ
স্বামী কিসমত আলীকে হারিয়েছেন ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই নিখোঁজ তিনি। একাই তিন ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে লড়েছেন সংসার-যুদ্ধে। কখনও অন্যের বাড়ি গৃহকর্মীর কাজ করেছেন, কখনও কারখানায় তৈরি করেছেন বিড়ির বান্ডিল। পড়াশোনা বেশিদূর করাতে পারেননি ছেলেদের। তবে মেয়েদের উপযুক্ত বয়সে বিয়ে দিয়েছেন। ছয় সন্তানের কারও কাছে জায়গা হয়নি মার্জিয়া বেগমের (৮৮)।
২০১৪ সালে তিন ছেলে এই নারীকে রেখে যান টিএমএসএস মাসুদা প্রবীণ নিবাসে। ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস) পরিচালিত এই নিবাসটি পড়েছে বগুড়া সদরের বাঘোপাড়ায়। পাশ দিয়ে চলে গেছে বগুড়া-রংপুর মহাসড়ক। নিবাসের মাত্র কিলোমিটার দূরেই বাড়ি মার্জিয়ার তিন ছেলের। কাছাকাছি বাড়ি হলেও ১০ বছরে একবারের জন্যও মার্জিয়াকে দেখতে আসেনি কোনো সন্তান। সবই যেন তাঁর কপালের দোষ– ভাঙা কণ্ঠে এমন কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন এই নারী।
বহু আগে ‘প্রবীণ’ কবিতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘নবীন বয়স যেই পেরোল খেলাঘরের দ্বারে/ মরচে-পড়া লাগল তালা, বন্ধ একেবারে।/ ভালোমন্দ বিচারগুলো খোঁটায় যেন পোঁতা।/ আপন মনের তলায় তুমি তলিয়ে গেলে কোথা।/ চলার পথে আগল দিয়ে বসে আছ স্থির–/ বাইরে এসো, বাইরে এসো, পরমগম্ভীর।/ কেবলই কি প্রবীণ তুমি, নবীন নও কি তাও।/ দিনে দিনে ছি ছি কেবল বুড়ো হয়েই যাও।’ কৈশোর, যৌবন ও মধ্যবয়সে জীবনের নানা পালাবদল দেখে এসেছেন টিএমএসএস মাসুদা প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দা ২৪ মা। শেষ বয়সে এসে কোনো দুঃখই যেন আর দুঃখ নয় তাদের কাছে। আফসোস এটুকুই, জীবন সায়াহ্নের সময়টুকু নাড়িছেঁড়া ধন– সন্তানের কাছে কাটাতে পারছেন না তারা।
গতকাল শনিবার এখানেই জীবনের গল্প বলছিলেন মার্জিয়া বেগম। ‘স্বামী হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে ছোট ছোট ৬ ছেলেমেয়েকে বড় করেছি। খেয়ে, না খেয়ে তাদের জন্য লড়াই করেছি। দুর্ভিক্ষ-বন্যাসহ কত কি পাড়ি দিয়েছি। এখন সন্তানরা ফিরেও তাকায় না।’ এখানে তারা রেখে গেছে, এ নিয়ে তাঁর কোনো আফসোস নেই। তবে মুখের দেখা দেখতেও তো আসতে পারত।
কিন্তু ১০ বছরেও কোনো সন্তানের এই সময়টুকুও হয়ে উঠেনি– মুখে বলিরেখায় যেন অব্যক্ত বেদনা মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর কণ্ঠে। বললেন, ‘আমি তো মা, জীবনের শেষ সময়ে কলিজার টুকরোগুলোর মুখটুকু দেখতে ইচ্ছে করে!’ মাঝে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মার্জিয়া। তখনও তাঁকে দেখতে আসেনি ছেলেমেয়ে।
সাত বছর ধরে এই নিবাসে আছেন গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর হাজেরা খাতুন (৭৩)। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক এই অপারেটর বলেন, অবসরের পর পরই তাঁর স্বামী মারা যান। জামাতা ও তাঁর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মিলে একমাত্র মেয়ে তাঁর জমানো সব টাকা আত্মসাৎ করে। পেনশনের টাকার জন্যও চাপ দিতে থাকে। একমাত্র সন্তানের কাছ থেকে পাওয়া এই যন্ত্রণা সইতে পারেননি তিনি। প্রবীণ নিবাসে ঠাঁই নেন। অশ্রুভেজা চোখে হাজেরা বলেন, ‘স্বামী ছাড়া আমার কেউ আপন ছিল না। যে যার মতো করে সবকিছু নিয়ে আমাকে ছুড়ে ফেলেছে। আক্ষেপ থাকলেও কষ্ট নেই। সবাই ভালো থাকুক– এ দোয়াই করি।’
মেয়ে ও জামাতা কয়েকবার দেখা করতে এসেছিল এখানে। কিন্তু আত্মসম্মানবোধ থেকে তাদের সঙ্গে দেখাই দেননি হাজেরা। মৃত্যুর পর এখানেই সমাহিত হতে চান।৩০ বছর আগে স্বামী মারা যান জরিনা বেওয়ার। প্রতিবেশীর বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাজ করেছেন গৃহকর্মী হিসেবে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে একমাত্র ছেলেকে শিক্ষকতার পেশা পর্যন্ত পৌঁছে দেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার বালুয়াহাটের এই বাসিন্দা। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা তাঁকে শিক্ষক ছেলেই দেয়। মাকে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। প্রতিবেশী এক নারীর মাধ্যমে ৫ বছর আগে এই নিবাসে আশ্রয় নেন। জরিনার স্মৃতিতে সেই ছোট্ট ছেলেই ঘুরছে এখনও।
তিনি বলেন, ‘ছেলে ছোট থাকতে কথা দিয়েছিল– বড় হয়ে রিকশা চালিয়ে হলেও আমাকে খাওয়াবে। কোনো কষ্ট পেতে দেবে না। অথচ সেই ছেলের মারধরে আমি ঘরছাড়া। একবারের জন্যও দেখতে আসে না। একমাত্র নাতনিকেও দেখতে পারি না।’ এর পরও তাদের মঙ্গলের জন্য দোয়া করে যান জরিনা। তিনি গত ঈদুল ফিতরে সারাটা দিন অপেক্ষা করেছিলেন ছেলের জন্য। সকাল, সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেও তাঁর ছেলে আসেনি। কথাগুলো বলতে বলতে জরিনার শূন্যদৃষ্টি দূরে হারিয়ে যায়।
টিএমএসএস রিলিজিওন কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দা রাকিবা সুলতানার কাছে এখানে আশ্রিত সবাই তাঁর মা। তিনি বলেন, ‘আমরা অনুভব করি, তাদের চাইতে অসহায় পৃথিবীতে কেউ নেই। এ জন্য সব সুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখি। তাদের চাহিদাও সীমিত। তবু সন্তানরা দেখাশোনা করেন না।’ অনেকের সন্তান তো দেখতেও আসেন না জানিয়ে তিনি বলেন, এমনকি মারা গেলে মরদেহও নেন না। ধর্মীয় রীতি মেনে তারাই দাফনের ব্যবস্থা করেন।