
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
দিনে দুপুরে বাসা বাড়িতে চুরি-ছিনতাই
লাগামহীন চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা
অদৃশ্য কারণে নীরব ভূমিকায় থানা পুলিশ
প্রশাসন বলছে জিরো টলারেন্স
সময় বদলালেও বদলায়নি ক্রমে আতঙ্ক হয়ে ওঠা ‘কিশোর গ্যাং’ সদস্যরা। ৫ আগস্টের পর কেউ দল বদলেছে, কেউ বদলেছে আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা। কেউ আবার পুরোনোকে সরিয়ে আবির্ভূত হয়েছে নতুন রূপে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তথ্য বলছে, সম্প্রতি এই গ্যাংয়ের সদস্য আরও বেড়েছে। সারাদেশেই তাণ্ডব চালাচ্ছে তারা।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত পর আবারও উত্তরার বিভিন্ন সেক্টর ও নতুন ওয়ার্ডের পাড়া মহল্লায় কিশোর গ্যাং এর উৎপাত অনেক গুণে বেড়েছে বলে জানা যায়। এতে এলাকাজুড়ে বেড়েছে দখল, চাঁদাবাজি, চুরি ছিনতাই ও মারামারির মতো জঘন্য ঘটনা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এলাকার কথিত রাজনৈতিক নেতারা তাদেরকে ব্যবহার করে নিজেরা ফায়দা নিচ্ছে। কথিত নেতাদের শেল্টারে বেপরোয়া এ কিশোর গ্যাংয়ের হাতে নাজেহাল হচ্ছে এলাকার ব্যবসায়ী সমাজ ও সাধারণ জনগণ।
দিনে দুপুরে বাসাবাড়িতে চুরি, ছিনতাই ছাড়াও এ চক্রটি প্রায়ই তুরাগ নয়ানগর, দলিপাড়া, বাউনিয়া, কামারপাড়া, দক্ষিণখান, ট্রান্সমিটার, মোল্লাবাড়ী, হলান, আজমপুর, আশকোনা, কাওলা, খিলক্ষেত নিকুঞ্জ, উত্তরখান মাদার বাড়ি, মাজারপাড়া, বড়বাগ, চাঁনপাড়া, তেরমুখ, উত্তরখান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ পাড়া মহল্লার বাসাবাড়ি, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্কুল কলেজের মূল্যবান বৈদ্যুতিক তার রাতের আধারে কেঁটে নিয়ে যায়।
জানা যায়, কিশোর গ্যাং এর সাথে জড়িত রয়েছে এলাকার বখাটে যুবক, ছিঁচকে চোর, ছিনতাইকারী ও বিপদগামী কিছু স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় সময়ই নির্মাণাধীন ভবনের মূল্যবান রড, সিমেন্ট চুরির ঘটনায় এলাকাবাসী চোরকে ধরে থানা পুলিশকে জানালেও চোরের বয়স কম হওয়ার কারণে থানা পুলিশ ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, উত্তরায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানামুখী অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। নিজেদের হিরোইজম জাহির করতে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কারবার এমনকি খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে এসব কিশোর-তরুণ। এতে আতঙ্কিত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহর-পাড়া-মহল্লার বাসিন্দারা। আওয়ামী লীগের পতন হলেও দল পাল্টে এখনো অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। অতীতের মতো এখনো রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় তারা।
এসময় স্থানীয় পথচারীরা জানান, এই গ্রুপের সদস্যদের জ্বালায় রাতের বেলায় বউ বাচ্চা নিয়ে উত্তরার রাস্তায় চলাচল করতে পারি না । তারা এতোটাই ভয়ংকর যে সামান্য বিষয়ে গায়ে পরে মানুষকে রাস্তায় অপমান, নাজেহাল ছাড়াও খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না। রাত হলে তারা উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরের অলিগলি, বড় বড় শপিং কমপ্লেক্সের সামনে, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, তুরাগ, আব্দুল্লাহপুর চৌরাস্তা বাসস্ট্যান্ড, টঙ্গী ব্রিজের কোনায়, উত্তরা বিভিন্ন মদের বার ও সুইজ গেইট এলাকায় অবস্থান নেয়। সংঘবদ্ধ এ চক্রটি সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে পথচারীদের মোবাইল, মানিব্যাগ ও মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায়।
জানা যায়, বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের লাগামহীন চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ উত্তরার ব্যবসায়ীরা। তবে পুলিশের কাছে শুধু কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের আলাদা কোনো তথ্য নেই। সদস্য বাড়া ও তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড বিবেচনায় বলছে কিশোর গ্যাং আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
ভুক্তভোগীরা জানায়, উত্তরা পশ্চিম থানার আশপাশে কিশোর গ্যাং দেখা গেলেও অদৃশ্য কারণে থানা পুলিশ তাদের আটক করছে না। বিভিন্ন সন্ত্রাসী অপরাধ মূলক কাজ কর্মে জড়িত থেকে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করলেও বর্তমানে তারা নতুন রাজনৈতিক দলের সাথে আঁতাত করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি ঢাকার উত্তরা জসিমউদ্দিন এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হয়েছে পথচারী। ছিনতাই করতে বাধা দিলে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা। ইতিমধ্যেই নেট দুনিয়া ভাইরাল হয়েছে ঘটনাটি।
আব্দুল্লাহপুর এলাকায় মোবাইল ছিনতাইয়ের সময় বাধা দিলে ছিনতাইকারীরা শাহনাজ (৩৫) নামের এক মহিলার কানের লতি ছিঁড়ে কানের দুল ও মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়। শাহানাজ গার্মেন্টস শ্রমিকের কাজ করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ডিএমপির প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্য রয়েছে। ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ৪০ শতাংশই কিশোর। আগের চেয়ে তাদের দলের সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। তাদের হাতে এখন পিস্তলসহ আধুনিক ধারালো অস্ত্রও রয়েছে।
কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে এর আগেও র্যাবের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। পটপরিবর্তনের পর থেকে এসব কিশোর গ্যাং গ্রুপ কালচার আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে র্যাব। র্যাব-১ এর উপ-অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোহাম্মদ জাকিউল করিম।
দক্ষিণখান থানার অফিসার ইনচার্জ তাইফুর রহমান বলেন, এই মাসে আমরা যতজন আসামি গ্রেপ্তার করেছি তার মধ্যে কয়েকজন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ছিল। এ সকল কিশোররা মূলত ছিনতাই এবং মারামারিতে বেশি জড়িত থাকে। তিনি বলেন, এই মাসে যে সকল অভিযোগ এসেছিলো তা থেকে তদন্ত সাপেক্ষে কয়েকটি অভিযোগ মামলা হিসেবে রুজু হয়েছে। অপরাধ দমনে আমরা বিট পুলিশিং, কমিউনিটি পুলিশিং এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার জন্য এলাকায় এলাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে উঠান বৈঠক করছি।
উত্তরখান থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ জিয়াউর রহমান বলেন, আমরা অপরাধ দমনে প্রতিনিয়ত কাজ করছি। এই থানায় আগে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত ছিল, তাদেরকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতারা প্রশ্রয় দিতো সরকার পতনের পর তারা পালিয়ে গেছে।
উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোঃ মহিদুল ইসলাম (অতিরিক্ত ডিআইজি) বলেন, আমরা এই পর্যন্ত শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছি। উত্তরা এলাকায় যেকোনো অপরাধ হলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। গ্রেপ্তার করছি। গ্যাং কালচারের তথ্য পেলে আমরা যাচাই-বাছাই করে নির্মূলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের অভিযান চলমান। পাশাপাশি সমাজের সচেতন ব্যক্তিবর্গকেও এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, জনস্বার্থে তারা কিশোর গ্যাং সদস্যসহ কোন অপরাধীকে ছাড় দিবেন না। উত্তরাতে কিশোর গ্যাং এর জিরো টলারেন্স।