নিজস্ব প্রতিবেদক:
একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বর্তমানের বাংলাদেশ। এ সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা। এই গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ, নিরাপদ ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে ব্লকচেইনের মতো প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রাথমিকভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে এর প্রয়োগ হলেও ব্লকচেইন প্রযুক্তি সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে বিশ্বব্যাপী। এর সঠিক ব্যবহারে ভোট এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যেতে পারে। প্রথাগত ভোটিং সিস্টেমের দুর্বলতাগুলো দূর করে এবং স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে ব্লকচেইন একটি নির্ভরযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।
ব্লকচেইন হলো একটি বিকেন্দ্রীকৃত ও বণ্টিত ডিজিটাল লেজার; যা অনেক কম্পিউটারে লেনদেনকে এমনভাবে রেকর্ড করে, যাতে নিবন্ধিত ডেটা অপরিবর্তনীয়, স্বচ্ছ এবং সুরক্ষিত থাকে। ব্লকচেইনে একবার তথ্য যোগ করা হলে পুরো নেটওয়ার্কের সব নোড থেকে সম্মতি না এলে তা পরিবর্তন করা যায় না। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে যেসব ক্ষেত্রে দৃঢ় নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার প্রয়োজন হয়, সেসব ক্ষেত্রে ব্লকচেইনের ব্যবহার খুবই উপযুক্ত। ভোট দেওয়া এর অন্যতম উদাহরণ।
সাধারণ তথ্যভান্ডারের পরিবর্তে একটি বিকেন্দ্রীভূত ও অপরিবর্তনীয় লেজার বা খতিয়ান ব্যবহারের মাধ্যমে ব্লকচেইন প্রথাগত ভোটিং সিস্টেমের অনেক দুর্বলতা ও সমস্যা নিরসন করতে পারে এবং এর ফলে আরও নির্ভরযোগ্য এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত হতে পারে।
ব্লকচেইন কীভাবে নির্বাচনী চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান দিতে পারে তা নিচে দেখানো হলো:
ভোটার জালিয়াতি: যেহেতু ব্লকচেইন প্রতিটি ভোটকে অনন্য হিসেবে গণ্য করে এবং প্রতিটি ভোটের জন্য একটি অপরিবর্তনীয় অডিট ট্রেল নিশ্চিত করে, গোপনীয়তা বজায় রেখে প্রত্যেক যোগ্য ভোটারের পরিচয় যাচাই করা হয় এবং তাঁর পরিচয়কে একটি অনন্য ডিজিটাল স্বাক্ষরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়, যাতে তিনি শুধু একটি ভোট দিতে সক্ষম হন,
তাই এ ব্যবস্থায় একজন ভোটারের পক্ষে একাধিক ভোট দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ব্লকচেইনে একবার একটি ভোট রেকর্ড করা হলে এটি পরিবর্তন বা অপসারণ করা যায় না, ফলে ভোট জালিয়াতি অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ম্যানিপুলেশন এবং টেম্পারিং: ব্লকচেইন প্ল্যাটফর্মে কোনো ভোট দেওয়া হলে তা একটি বিকেন্দ্রীকৃত ও সর্বজনীন বা অনুমোদিত লেজারে লেনদেন হিসেবে রেকর্ড করা হয়। অর্থাৎ ভোটটিকে একাধিক নোডজুড়ে বিতরণ করা হয়। ভোটগুলো সঠিকভাবে গণনা করা হলো কিনা, তা পরবর্তী সময়ে যথাযথ অনুমতি পাওয়া যে কেউ যাচাই করতে পারেন। এমন একাধিক স্তরের স্বচ্ছতার কারণে নির্বাচনের ফল সম্পর্কে সন্দেহ বা অবিশ্বাস অনেকাংশে কমে যায়, কারণ কেউ ডেটা ম্যানিপুলেট বা হেরফের করতে গেলে তাকে শনাক্তকরণ খুব সহজ হয়ে যায়।
স্বচ্ছতার অভাব: ব্লকচেইনের বিকেন্দ্রীকৃত প্রকৃতি এটিকে হ্যাকিং এবং জালিয়াতি প্রতিরোধী করতে সক্ষম। প্রথাগত ভোটিং সিস্টেমে একটি মাত্র দুর্বল পয়েন্ট পুরো প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। অন্যদিকে ব্লকচেইন পদ্ধতিতে সব ডেটা একাধিক নোডজুড়ে বণ্টিত থাকায় প্রতিটিতে ভোটের রেকর্ডের একটি করে কপি থাকে। যদি একটি নোড লঙ্ঘিত হয়, অন্য নোডগুলো নির্বাচনের সাধুতা বজায় রাখতে পারে। অধিকন্তু, ব্লকচেইনে ব্যবহৃত ক্রিপ্টোগ্রাফিক কৌশল ভোটের রেকর্ডের সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং ভোটারের নাম অপ্রকাশিত রেখে গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারে।
কম ভোটার উপস্থিতি: ব্লকচেইনভিত্তিক ভোটিং ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে সরকার অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিকল্প ভোটিং পদ্ধতিরও উপস্থাপন করতে পারে। এ রিমোট ভোটিং যথেষ্ট নিরাপদ ও সুবিধাজনক, যা ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে বাড়াতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে যারা প্রতিবন্ধী, বয়স্ক বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন, তারা এর ফলে উপকৃত হবেন।
উচ্চ পরিচালন ব্যয়: ব্লকচেইনভিত্তিক ভোটিং সিস্টেম বাস্তবায়ন করে সরকার নির্বাচনী খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে। প্রথাগত প্রক্রিয়ার বিক্ষিপ্ততা কমিয়ে এনে ব্লকচেইন প্রক্রিয়াটিকে অনেকটাই সুবিন্যস্ত করতে পারে, যা উল্লেখযোগ্য খরচ কমাতে অবদান রাখতে পারে। উপরন্তু, ব্লকচেইন প্রযুক্তি ভোট প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা উন্নয়ন করতেও সক্ষম। ব্লকচেইনভিত্তিক সিস্টেমে যুগপৎ বা রিয়েল টাইমে ভোট গণনা করা যায়। এই স্বয়ংক্রিয় ভোট গণনা হস্তসাধিত ত্রুটির ঝুঁকিও কমিয়ে দেয়, যা প্রায়ই গতানুগতিক নির্বাচনের একটি বড় সমস্যা বলে পরিলক্ষিত হয়।
ভোটদান এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ব্লকচেইন প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি ভোটিং সিস্টেমের ন্যায্যতা, নিরাপত্তা ও কার্যক্ষমতা বহুগুণে বাড়াতে পারে। বিশ্বব্যাপী যেভাবে এখন নির্বাচন পরিচালিত হয়, ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার ব্যাপক উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। নিশ্ছিদ্র ডেটা সুরক্ষা, যুগপৎ ভোট গণনা এবং খরচ-সঞ্চয় নিশ্চিত করার কারণে ব্লকচেইন ভোটিং গণতন্ত্রের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
সৈয়দ আলমাস কবীর: উদ্যোক্তা, আইসিটি জ্ঞানার্থী, পলিসি প্রবক্তা