ভুয়া বিল-ভাউচারে এতিমের টাকা আত্মসাৎ সমাজসেবা কর্মকর্তার

প্রকাশিত: ৩:১২ অপরাহ্ণ, জুন ১২, ২০২৪

রংপুর প্রতিনিধি:

এতিম শিশু নেই, নেই কমিটি। তবুও আসে এতিমখানার নামে বরাদ্দ। বরাদ্দের টাকা উত্তোলনও করা হয়। তবে তা এতিমখানায় ব্যবহার হয় না। পকেট ভরে কর্মকর্তা ও তত্ত্বাবধায়কের। এতিমখানাটি হলো রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার আল আমিন শিশু সদন। এ শিশু সদনে ভুয়া এতিম শিশু দেখিয়ে ভুয়া বিল, ভাউচার দাখিল করে বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সামিউল ইসলামের বিরুদ্ধে। তবে এ কর্মকর্তার দাবি, তিনি টাকা উত্তোলন করে অফিসিয়াল হিসাবে জমা রেখেছেন।

নিয়ম রয়েছে, সংশ্লিষ্ট সরকারি কার্যালয়ে বেসরকারি এতিমখানা কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত কমিটির স্বাক্ষরিত নিবাসী এতিমদের তালিকা ও ব্যয়ের বিল ভাউচার দাখিল করবে। সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা কর্মকর্তা ওই এতিমখানার নিবাসী এতিম শিশুর সংখ্যা, কমিটির মেয়াদ যাচাই-বাছাই করে এতিম শিশুর খাওয়া, পোশাক ও চিকিৎসার ব্যয় বিল ভাউচার অনুমোদন দেবে। বেসরকারি এতিমখানায় অবস্থানরত এতিমের মোট সংখ্যার সর্বোচ্চ ৫০ ভাগ ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ডের জন্য বিবেচিত হবে।

মাত্র ৩ থেকে ৪ জন এতিম শিশু থাকা শিশু সদনটির কার্যকারী কমিটির মেয়াদ শেষ হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি। নতুন করে এখনো কোনো কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়নি সেখানে। অথচ সরকারি নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অনুমোদনহীন কার্যকারী কমিটি ও তত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষরিত ভুয়া ব্যয় বিল ভাউচার অনুমোদন করে এতিম শিশুর জন্য ষান্মাসিক বরাদ্দ বাবদ ৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সামিউল ইসলাম। ৬ জুন ওই টাকা উত্তোলন করা হয় বলে জানিয়েছে উপজেলা হিসাব রক্ষণ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। গ্র্যান্ড প্রাপ্তির শর্ত মোতাবেক চলতি অর্থবছর আল আমিন শিশু সদন এতিমখানায় ৫৮ জন এতিম নিবাসীর জন্য মোট এতিম থাকতে হবে ১১৬ জন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আল আমিন শিশু সদনটিতে ৮ থেকে ১০ জন এতিম ও দুস্থ শিশু রয়েছে। অথচ চলতি অর্থবছরে সেখানে অতিরিক্ত ভুয়া নিবাসী এতিম শিশু দেখিয়ে ৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা ও ২০২২-২০২৩ অর্থবছর ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হলেও তেমন খরচ করা হয়নি। সমাজসেবা কর্মকর্তা ও শিশু সদনটির দায়িত্বরতরা নাম মাত্র খরচ করে তা আত্মসাৎ করেন। বছরের পর বছর এমনই চলে আসছে।

সরেজমিনে শিশু সদনটিতে গিয়ে দেখা গেছে, দ্বিতল ভবনের নিচতলায় মসজিদে নামাজ আদায় করা হয়। আর দ্বিতীয় তালায় তিনটি রুমে এতিম শিশুদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ছয় থেকে ১৫ বছর বয়সী ৮ থেকে ১০টি শিশুর দেখা মেলে। তাদের মধ্যে ভায়ারহাট গ্রামের দেলওয়ার, হোসেন মিয়া, সদরা তালুকের সিয়াম মিয়া, লালমসজিদ এলাকার রিফাত ও গাইবান্ধার আহসান হাবিব জানায়, তারা কয়েকমাস ধরে এখানে আছেন। তাদের সবার বাবা ও মা আছেন। তাদের অনেকে বাড়িতে থাকেন।
এতিমখানার হিফজখানার শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন জানান, এখানে মক্তব ও হিফজখানায় পড়ে প্রায় ৩০ জনের মতো শিশু। এরমধ্যে ৩ থেকে ৪ জন এতিম শিশু রয়েছে। গত বছর তিন-চার মাস প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ ছিল।

ওই শিশু সদনের তত্ত্বাবধায়ক মাওলানা ছমির উদ্দিন আরও বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে এতিমখানার কমিটির মেয়াদ শেষ হলে নতুন কমিটি জমা করা হয়। পূর্বের সভাপতিকে বাদ দিয়ে উপজেলা কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত লোককে সভাপতি করে কমিটি গঠন করে। কমিটি এখনো অনুমোদন হয় নাই। আগের কাগজপত্র বাতিল করে আবারও ব্যয় বিল ভাউচার তৈরি করা হয়। ভুয়া এতিম দেখিয়ে অর্থের অনিয়ম যদি হয়ে থাকে তার দায়ভার উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার।

তবে শিশু সদনটির সাবেক সভাপতি বলেন, আমি সভাপতি থাকাকালীন আবাসিক অনাবাসিকে ১৫ থেকে ১৮ জন এতিম ও দুস্থ শিশু ছিল। টাকার অভাবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে শিশু সদনটি বন্ধ হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক বিভিন্ন কৌশলে অতিরিক্ত এতিম শিশু দেখিয়ে কর্মকর্তার যোগসাজশে সরকারি বরাদ্দের টাকা উঠায় ও খরচ করেন। তাকে বাধা করলেও কোনো কাজ হয় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার সামিউল ইসলাম বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানে অল্প সংখ্যক হলেও এতিম ও দুস্থ শিশু খাওয়া দাওয়া করে। বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা না হলে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ড বাতিল হয়ে যাবে। তাই বিভিন্ন সুপারিশে ১ম কিস্তির বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসেবে হস্তান্তর করা হয়নি। তবে অনুমোদনহীন কমিটির স্বাক্ষরে এতিমের টাকা উত্তোলন ও এতিমখানায় ১২০ জন নিবাসী শিশু থাকার প্রত্যায়ন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
এদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তর রংপুরের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন বলেন, আল আমিন শিশু সনদ এতিমখানার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভুয়া এতিম সাজিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। ওই প্রতিষ্ঠানে চলতি অর্থবছর বরাদ্দের টাকা ছাড় না করার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা অফিসারকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তবে কৌশলগতভাবে টাকা উত্তোলন করে থাকলে এর দায় সংশ্লিষ্ট অফিসারকে নিতে হবে।

এতিমের বরাদ্দ লোপাটের বিষয়টি রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসানের নজরে আনা হলে তিনি বলেন, ওই এতিমখানায় কোনো এতিম শিশু নেই। ইউএনও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এতিমের বরাদ্দ লোপাটসহ সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।