আফরিন আক্তারঃ
পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত নাম পিএলসি। যাকে বলা হয়, পেপার লাইন ক্লিয়ার। একটি চলন্ত ট্রেন সামনের স্টেশন অতিক্রম করবে কি না, অথবা ট্রেনটিকে ক্রসিংয়ের জন্য কোথায় থামতে হবে, অথবা ট্রেনটির অনির্ধারিত স্টপেজ কোন স্টেশনে দেয়া হয়েছে-এসব বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা একটি কাগজে লিখেন স্টেশন মাস্টার। এরপর ওই কাগজটি ভাঁজ করে একটি লম্বা তার দিয়ে অর্ধ গোলাকৃতির কুন্ডলী তৈরি করেন। সেই কুন্ডলীটি স্টেশনের রেললাইনের পাশে উঁচু করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন স্টেশন মাস্টার। চলন্ত ট্রেনটি স্টেশন অতিক্রম করার সময় ইঞ্জিনে থাকা লোকমাস্টার কুন্ডলীর মাঝখানে ফাঁকা স্থানে হাত ঢুকিয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেন সেটি। সেটার সঙ্গে থাকা কাগজটি লোকোমাস্টার পড়ে সামনের স্টেশন সম্পর্কে ধারণা নেন। এভাবেই বৃটিশ আমলের সিগন্যাল সিস্টেম দিয়ে বাংলাদেশে সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথের প্রতিদিন সাড়ে ৩শ যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে।
উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে আমাদের পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালে রেলওয়ের সিগন্যাল সিস্টেম পরিচালনা করা হয় আধুনিক প্রযুক্তিতে। গোটা ভারতে প্রায় ২ লাখ কিলোমিটার রেলপথ পরিচালনা করা হয় টেলিকম সিস্টেমে। প্রতিটি জোনে নির্দিষ্ট টেলিকম ব্যবস্থা রয়েছে। চলন্ত ট্রেনের লোকোমাস্টার, পরিচালক, ইঞ্জিন ক্রু, টেকিনিশিয়ান থেকে শুরু করে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রেল পুলিশের হাতে ওয়াকিটকি থাকে। সেই ওয়াকিটকি দিয়ে প্রত্যেকেই কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কোন লাইনে তার সিগন্যাল ক্লিয়ার রয়েছে-সেটা লোকোমাস্টার ওয়াকিটকিতে জানতে পারেন। বাংলাদেশের রেলওয়েতে এরকম কোন প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হয় না।
রেলের এ পরিস্থিতি দেখে কয়েক বছর আগে রেল মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব গণমাধ্যমের কাছে মন্তব্য করেছিলেন, ‘রেলের ব্যবহূত এ্যানালগ সিস্টেমের সিগন্যালের ৯০ শতাংশই অকার্যকর। বেশিরভাগ সময় স্টেশন মাস্টাররা বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে পিএলসি সিস্টেমে তথ্য আদান প্রদান করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশে রেল চলে এ্যানালগ সিস্টেমে’। ওই অতিরিক্ত সচিব রেলের সিগন্যাল সিস্টেমকে আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ নিলে একটি চক্র তার ওপর উঠে পড়ে লাগে। এরপরই তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
রেল মন্ত্রনালয় সূত্র জানায়, নামমাত্র স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পয়েন্ট থাকলেও ‘ম্যানুয়ালি’ সিগন্যাল ব্যবস্থা একমাত্র ভরসা। তবে এতে বিন্দুমাত্র আস্থা রাখতে পারেন না মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রেলের ছোট-বড় দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই ঘটছে সিগন্যাল ব্যবস্থার ক্রুটির কারণে। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলের অধিকাংশ সেকশনে ব্রিটিশ আমলের সিগন্যাল ব্যবস্থা এখনো বিদ্যমান। ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দভাগ রেলস্টেশনে তুর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের সংঘর্ষে ২২ জন নিহত এবং ১২০ জন আহত হন। ঘন কুয়াশার মধ্যে এ্যানালগ সিস্টেমের সিগন্যাল অর্থাত্ রেললাইনের আউটার সিগন্যালে স্থাপন করা পাখা-বাতি দেখতে না পেয়ে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। পরের বছর কুমিল্লার লাঙ্গলকোটে ভুল সিগন্যালের কারণে দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ৭০ জন আহত হন। গত বছরের ২৩ অক্টোবর ভৈরব রেল জংশনের আউটার সিগন্যালে একটি মালবাহী ট্রেন ভুল সিগন্যাল পেয়ে জংশনে প্রবেশ করতে থাকে। একই সময় ঢাকাগামী এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস ট্রেনটিও জংশন থেকে বের হচ্ছিল। দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ২২ জন নিহত ও আহত হয় শতাধিক। চলতি বছরের ১৮ মার্চ কুমিল্লার লাঙলকোটের হাসানপুর রেলস্টশনের কাছে চট্টগ্রাম থেকে জামালপুরগামী বিজয় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কবলে পরে ৭ টি কোচ লাইনচ্যূত হয়। গত ১৮ এপ্রিল পটিয়া রেলস্টেশনে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ননস্টপেজ সার্ভিসের দুইটি ট্রেন পর্যটক এক্সপ্রেস ও কক্সবাজার এক্সপ্রেসের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ থেকে বেঁচে যায়।এসব দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত রিপোর্ট বলছে, সিগন্যাল ব্যবস্থা ত্রুটির কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) তথ্য বলছে, এশিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ রেল অবকাঠামোর দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
রেল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সরদার শাহাদত আলী বলেন, রেলের জনবলের সংকট রয়েছে। জনবলের অভাবের কারণে স্টেশন, রেললাইন ও ট্রেন পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। একটি স্টেশন পরিচালনা করতে যেখানে গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন জনবলের প্রয়োজন, সেখানে অর্ধেক জনবল দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। এমনও রেলস্টেশন রয়েছে যেখানে ১ জন অথবা সর্বোচ্চ ২ জন দিয়ে একটা স্টেশন পরিচালনা করা হচ্ছে। মানে একজন রেল কর্মচারীকে ২৪ ঘন্টা ডিউটি করতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি পরীক্ষা দিয়ে প্রায় সাড়ে ৭শ সহকারী স্টেশন মাস্টার নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়। এদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মস্থলে পাঠানোর পর দেখা যায় মাত্র আড়াইশ জন যোগদান করেছেন। মেধাবীরা অন্য চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ায় রেলে যোগদান করেননি। এরকম রেলের সব পদেই হচ্ছে। আমাদের ট্রেনের সংখ্যা ও লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ছে-কিন্তু সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়ন হচ্ছে না। সিগন্যাল বিভাগে সবচেয়ে কম জনবল। ২৪ ঘন্টা একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কম জনবল দিয়ে রেল পরিচালনা করতে গিয়ে প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যাত্রীরা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে সারাদেশে ১৬০টি নতুন ট্রেন চালু করেছে। সরকার রেলে ব্যাপক উন্নয়ন করলেও সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়ন উপেক্ষিত রয়েছে। আবদুল্লপুর-পার্বতীপুর, দর্শনা-খুলনা, পোড়াদহ-রাজবাড়ী, শান্তাহার-লালমনিরহাট, পার্বতীপুর-কাউনিয়া, দেওয়ানগঞ্জ-জয়দেবপুর, ময়মনসিংহ-গৌরিপুর-ভৈরব, আখাউড়া-সিলেটসহ অধিকাংশ সেকশনে ম্যানুয়ালি পাখা-বাতি সিগন্যাল ব্যবস্থায় ট্রেন চালানো হচ্ছে। এসব সেকশনের ৭৬টি রেলস্টেশনে কোনো ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা নেই। বাঁশের মই ব্যবহার করে নির্ধারিত পিলারে লাল-সবুজ বাতি লাগিয়ে ট্রেনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়।
রেল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সরদার শাহাদত আলী গতকাল বলেন, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনে সিবিআই ও সিটিসি সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপনের একটি প্রকল্পের কাজ চলমান। এছাড়া আখাউড়া-ভৈরব সেকশনসহ পদ্মা সেতু লিংক লাইন স্থাপন প্রকল্পে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ চলছে।