ভেকুতে পাওয়া কঙ্কালের সূত্র ধরে পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে এলো খুন হওয়া রুমানের পরকীয়া প্রেমের গল্প

প্রকাশিত: ৬:৫২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৯, ২০২৩

এসএম দেলোয়ার হোসেন:
রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বাঘাসুর পশ্চিমপাড়া এলাকার মৃতপ্রায় সিংহ নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে চলতি বছরের ২১ মে ভেকু দিয়ে খনন কাজ করছিলেন শ্রমিকরা। সেই খনন কাজ দেখতে স্থানীয় উৎসুক জনতাও জড়ো হয়েছিলেন সেখানে। নদীর কচুরিপানা ও ময়লা-আবর্জনা তুলতে গিয়ে ভেকুতে উঠে আসে অজ্ঞাতনামা এক যুবকের কঙ্কাল। সেই কঙ্কালের পাশেই নীল রংয়ের শার্টের একটি অংশ দেখতে পান কর্মজীবি শ্রমিকরা। মুহুর্তের মধ্যেই এ খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ঘটনার একমাস আগে নিখোঁজ হওয়া স্থানীয় চা দোকানি রুমান শিকদারের স্বজনরা। তারা সেই নীল রংয়ের শার্টের অংশবিশেষ দেখে মানবদেহের ওই কঙ্কালটি রুমান শিকদারের বলে দাবি করেন। এরপর স্থানীয়রা বিষয়টি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে জানান। খবর পেয়ে কেরানীগঞ্জ থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মাইদুল ইসলামসহ সঙ্গীয় ফোর্স ঘটনাস্থলে ছুটে যান। মানবদেহের সেই কঙ্কাল উদ্ধারের পর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ প্রোফাইলের জন্য পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। সিআইডির ডিএনএ ল্যাবে সেই নমুনা পরীক্ষায় নিখোঁজ রুমান শিকদারের পরিচয় নিশ্চিত হয়। এরপর পুলিশ বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে রহস্য উদঘাটনে তদন্তে নামে। কিন্তু ক্লুলেস সেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ধার করতে পারেনি থানা পুলিশ। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে গত ২২ আগস্ট ঘটনার তদন্তে নামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অবশেষে ঘটনায় জড়িত নারীসহ দু’জনকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে ক্লুলেস সেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য খুঁজে পায় পিবিআই।
সংস্থাটি বলছে, পরকীয়া প্রেমের বিষয়টি স্থানীয়দের কাছে ফাঁস করে দেওয়ায় প্রেমিকার পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। পরবর্তীতে ঘাতকরা সিংহ নদীর পাড়ে মরদেহ মাটিচাপা দেয়। গ্রেফতাররা হলেন- আঁখি আক্তার (২৪) ও আলাল মোল্লা (৩৫)। এ ঘটনায় আঁখির স্বামী ওমর ফারুক আগেই থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। গ্রেফতার দুই আসামি রুমান শিকদার হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। নিহত রুমান শিকদার একই এলাকার আবু শিকদারের ছেলে। আজ বুধবার (২৯ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা জেলা ইউনিটের ইনচার্জ পুলিশ সুপার মো. কুদরত-ই-খুদা।


তিনি বলেন, ঘাতক আঁখি আক্তার ও নিহত রুমান শিকদার (৩৯) একই এলাকার প্রতিবেশী। আঁখির স্বামী ওমর ফারুক প্রবাসী। এই সুযোগে প্রতিবেশী রুমানের সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন আঁখি। বিদেশ থাকাবস্থায় স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমের বিষয়টি জানতে পেরে দেশে চলে আসেন ওমর ফারুক। দেশে এসে এমন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে যাওয়ায় স্ত্রী আঁখিকে বাড়ি থেকে বের করে দেন তিনি। পরবর্তীতে দুই স্বজনদের মধ্যস্থতায় মীমাংসা করে আঁখি ও ওমর ফারুক সংসার শুরু করে। কিছুদিন না যেতেই আঁখি আবারও রুমানেরব সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পরেন। এরপর চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে রুমানের হাত ধরে পালিয়ে অন্যত্র কিছুদিন বসবাস শুরু করেন আঁখি। পরবর্তীতে ফারুক অনেক খোঁজা-খুঁজির পর আঁখি ও তার প্রেমিক রুমানের সন্ধান পায়। এরপর স্বজন ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও কোনো সুফল হয়নি। স্থানীয়রা রুমানকে তার প্রেমিকা আঁখিকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে রুমান তা অস্বীকার করেন।


পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার আরও বলেন, যার ফলে আঁখি আক্তার তার সমস্ত অন্যায় অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য স্বামী ফারুকের কাছে ক্ষমা চেয়ে সংসারে ফিরে যান। এই সময়ে তাদের বাসা ভাড়া করে থাকা ও পরকীয়ার বিষয়টি রুমানকে গোপন রাখতে অনুরোধ করেন। কিন্তু রুমান সেই অনুরোধ উপেক্ষা করে বিষয়টি এলাকায় বিভিন্নজনের কাছে প্রচার করে আসছিল। আর এতেই আঁখি ও ফারুক ক্ষিপ্ত হয়ে রুমানকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ২২ মার্চ গভীর রাতে মোবাইলে ফোন করে আঁখি আক্তার তার প্রেমিক রুমানকে ঘরে ডেকে নেন। এরপর আঁখি তার প্রেমিক রুমানের সঙ্গে একান্তে কথা বলার একপর্যায়ে পেছন থেকে লোহার রড দিয়ে রুমানের মাথায় সজোরে আঘাত করেন আঁখি ও তার স্বামী ওমর ফারুক। পরে তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে কেই যাতে তাকে চিনতে না পারে সেজন্য দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করেন তারা। পরে নিহতের লাশ বস্তাবন্দি করে গুমের উদ্দেশ্যে প্রতিবেশী আলাল মোল্লার সহযোগিতায় বাড়ির পাশের মৃতপ্রায় সিংহ নদীর পাড়ে মাটিচাপা দেন খুনিরা।


পুলিশ সুপার মো. কুদরত-ই-খুদা বলেন, প্রতিবেশী প্রেমিক চা দোকানি রুমানকে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়ার এক মাস পর চলতি বছরের ২১ মে মৃতপ্রায় সিংহনদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে খনন কাজ শুরু হয়। ওই সময়ে ভেকুতে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির কঙ্কাল উঠে আসে। বিষয়টি স্থানীয়রা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ জানালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ কঙ্কালের সঙ্গে একটি অস্পষ্ট নেভি ব¬ু রঙের শার্টের অংশ বিশেষ পায়। কঙ্কাল উদ্ধারের খবর পেয়ে রুমানের স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনরা গিয়ে প্রাথমিকভাবে এটি রুমানের মরদেহ দাবি করেন। পরবর্তীতে কেরানীগঞ্জ থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মাইদুল ইসলাম কঙ্কালের সুরতহাল প্রস্তুত করেন এবং ডিএনএ প্রোফাইলের জন্য কঙ্কালটি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে মর্গে পাঠায়। পাশাপাশি এসআই মাইদুল বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি ৫ মাস থানা পুলিশ তদন্ত শেষে দায়িত্ব পায় পিবিআই। গত ২২ আগস্ট মামলাটি তদন্ত শুরু করে পিবিআইয়ের ঢাকা জেলার একটি দল। এর আগে কঙ্কাল উদ্ধারের পর নিহতের স্ত্রী সেলিনা আক্তার ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন করেন। পরবর্তীতে নিহতের মেয়ে নুসরাত (১২) ও ছেলে সাইফের (৬) ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডি। ডিএনএ পরীক্ষায় রুমানের পরিচয় নিশ্চিত হয় তারা। এরপরই পিবিআইয়ের তদন্ত দল এলাকা ঘুরে রুমান শিকদার হত্যার রহস্য উদঘাটনে নানা কৌশলে ঘটনাস্থলসহ আশপাশের লোকজনদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তথ্য সংগ্রহ করে তা যাচাই-বাছাই করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়। এরপর সন্দেহভাজন নারীসহ দু’জনকে গ্রেফতার করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই বেরিয়ে আসে পরকীয়া প্রেম ও রুমান হত্যার গল্প।