ভোল পাল্টে বেপরোয়া ‘পল্লবীর আতঙ্ক’ আল ইসলাম, উৎকণ্ঠায় এলাকাবাসী

প্রকাশিত: ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৩১, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:

  • মিরপুরের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের নেপথ্যের কারিগর
  • ভাঙারির ব্যবসার আড়ালে মাদক ব্যবসায় কোটিপতি
  • পল্লবীতে অবৈধ দখল মানে আল ইসলাম
  • ৫ আগস্টের পর ভোল পাল্টে বিএনপিতে ভর
  • হত্যা, হামলা, মাদকসহ ডজন মামলার আসামী আল ইসলাম

রাজধানীর পল্লবীতে চাঁদাবাজি, মাদক কারবার আর দখল মানেই আল ইসলাম! নিরীহ কারও জমি কেনার তথ্য পেলেই হাজির হতেন আল ইসলাম ও তার ভাই জাহাঙ্গীরের লোকজন। নগদ চাঁদাবাজিতে সিদ্ধহস্ত দুই ভাই চাঁদা না পেলে হামলা করতেন। কখনো সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে মিথ্যা মামলায় করতেন দিনের পর দিন হয়রানি। বাধ্য হয়ে অনেকে জমি ছেড়ে যেতেন।

মাদক কারবারে জড়িত আল ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা, হামলা, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের অন্তত ডজনখানেক মামলা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাতারাতি ভোল পাল্টে পল্লবীর আতঙ্কে পরিণত হয়েছেন এই দুই সহোদর।

সর্বশেষ গতকাল বুধবার রাজধানীর পল্লবী থানাধীন বাউনিয়াবাদ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকেই এর নেতৃত্ব দেন আল ইসলাম। সেখান থেকে ছুটে আসা একটি গুলিতে আয়েশা আক্তার নামে এক নিরীহ গৃহবধূর মৃত্যু হয়। তিনি ওই সময় নিজের বাড়িতেই ছিলেন।

চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় পল্লবীজুড়ে আতঙ্ক আরও ছড়িয়ে পড়ে। রাতেই সেনাবাহিনীর একটি দল অভিযুক্ত আল ইসলামকে আটক করে পল্লবী থানা পুলিশে সোপর্দ করে

সর্বশেষ বুধবার রাত ১২ টার খবর অনুযায়ী, গৃহবধূর মৃত্যুর ঘটনায় আল ইসলাম ও তার ভাই জাহাঙ্গীরসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে পল্লবী থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

মিরপুর বিভাগ পুলিশ বলছে, দুই গ্রুপের মাদকের কারবার ও আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে সংঘটিত গোলাগুলিতে নিরীহ গৃহবধু হত্যাকাণ্ডের আল ইসলামের সরাসরি সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে পল্লবীসহ অন্যান্য থানায় অস্ত্র, মাদক, জমি দখলসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে মামলা রয়েছে। তাকে থানা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মাকছেদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আল ইসলামের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা রয়েছে। গুলিতে নারীর মৃত্যুর ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তিনি ঘটনাস্থালে উপস্থিত ছিলেন, হাইড (আড়াল) থেকে ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছেন। আল ইসলামসহ আমরা বেশ কিছু নাম জেনেছি। ওই ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অন্যান্য জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

পল্লবী থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বুধবার বিকেল সাড়ে ৩ টার দিকে পল্লবী থানাধীন মিরপুর সেকশন- ১১ এর বাউনিয়াবাঁধ বি ব্লকে চিহ্নিত অস্ত্রধারী মাদক ব্যবসায়ী সন্ত্রাসী মমিন, শাবু, সম্রাট, শামিম, জয়নাল, ইদ্রিস, কালা মোতালেব, কামাল, জাহাঙ্গীর, আল ইসলাম, ভেজাল মামুন, জয়, ইউনুস, রুবেলসহ অজ্ঞাত নামা ১৪/১৫ জন এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ফতের ভাই মামুনের কাছে চাঁদা চায়। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি ও তর্কের মধ্যে আধিপত্যের প্রদর্শনী পরিণত হয় গোলাগুলিতে। তাতে বাউনিয়াবাঁধ বি ব্লকের ১৭/১৮ বাসার দ্বিতীয় তলার সিড়ি করিডোরে দাঁড়ানো আয়েশা আক্তার গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।

গত ৬ আগস্ট সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তার উপর হামলা করে আল ইসলামের বাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট আবুল কালাম আজাদের হাত ভেঙ্গে ফেলা হয়। এছাড়া লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয় সমস্ত শরীরে।
নিহত আয়েশার (৩০) স্বামী মিরাজ পেশায় বাস চালক। তৃতীয় তলায় ১টি রুম নিয়ে ১০ বছর ধরে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করে আসছিলেন তারা।

এ ঘটনায় অভিযুক্তরা পল্লবী থানা শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান মামুন( ভারতে অবস্থানরত) এর অস্ত্রধারী ক্যাডার। এদের মধ্যে মমিন চাচাতো ভাই এবং রুবেল বোন জামাই। আল ইসলাম ও জাহাঙ্গীর নেপথ্যে থেকে দখল ও মাদক ব্যবসার আধিপত্যের লড়াই জিইয়ে রেখে চাঁদাবাজি করে আসছিলেন।

এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন উল্লেখ করে মিরপুর বিভাগের পল্লবী জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার পহন চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে।

ভাঙারি ব্যবসার আড়ালে মাদক কারবার

পল্লবী থানা পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পল্লবীর বাউনিয়াবাদ এলাকায় বেড়ে ওঠা আল ইসলাম ও তার ভাই জাহাঙ্গীর এক সময় নিজেরা ভাঙারি মালামাল কেনা-বেঁচা করতেন। তবে এর আড়ালে তারা শুরু করেন মাদকের কারবার। মাদক কারবারে জড়ানোর পর তাদের অর্থ সম্পদ ফুলে ফেঁপে বেড়ে যায়। সঙ্গে বাড়ে নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার।

পল্লবী এলাকায় মাদকের অন্যতম কারবারি এই আল ইসলাম ও তার ভাই জাহাঙ্গীর। মাদক কারবার চালানোর জন্য ৪০-৫০ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে তাদের। যাদের দিয়ে মাদক বিক্রি ও বিরোধী বা প্রতিপক্ষদের দমন করা হয়। ছোট ছোট এলাকা ভাগ করে এসব সহযোগীদের দায়িত্ব দেয়া হয়ে। তাদের দিয়ে ওইসব এলাকার মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ হয়।

মাদক কারবারের পাশাপাশি জমি দখল ও চাঁদাবাজিতেও সিদ্ধহস্ত আল ইসলাম

আল ইসলামের বিরুদ্ধে থানা পুলিশে অনেক অভিযোগ জমা পড়লেও অদৃশ শক্তিতে ছাড়া পেতেন তিনি। উল্টো তার হুমকি, হামলা, মারধর নির্যাতনে এলাকা ছাড়া অনেক ভুক্তভোগী। তবে পল্লবীতে জমি কিনতে বা ফ্ল্যাট করতে যারা চাঁদা দিতেন অথবা নির্যাতন নীরবে যারা সইতেন তারাই কেবল এলাকায় থাকতে পারছেন।

চাঁদা না দেয়ায় নির্যাতন, মামলা করে ভুক্তভোগীই এলাকা ছাড়া

শফিকুল ইসলাম নামে এক জমির মালিকের কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন আল ইসলাম। চাঁদা না দেওয়ায় তার ওপরে হামলা হয়। পিটিয়ে আহত করা হয় জমির কেয়ারটেকারসহ অন্যদের। মারধরের অভিযোগে ভুক্তভোগী শফিকুল ইসলাম মামলা করেন। এরপর প্রাণনাসের হুমকিতে নিজেই আর বাড়িতে থাকতে পারছেন না ভুক্তভোগী শফিকুল।

৫ আগস্টের পর স্থানীয় বিএনপিতে ভর

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে আল ইসলাম ও তার সহযোগীরা। স্থানীয় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মিরপুর পল্লবী এলাকার প্রভাবশালী বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন আল ইসলাম। সেই সখ্যতার ছবি প্রচার করে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আল ইসলাম।

গত ৬ আগস্ট সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তার উপর হামলা করে আল ইসলামের বাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট আবুল কালাম আজাদের হাত ভেঙ্গে ফেলা হয়। এছাড়া লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয় সমস্ত শরীরে। এই হামলার একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, আল ইসলাম ও তার সহযোগীরা ভুক্তভোগী আজাদকে ঘিরে ধরে। হাতে থাকা লাঠি দিয়ে মাঝ রাস্তায় ফেলে পেটানো হয় তাকে।

আল ইসলাম গ্রেপ্তারও কাটছে না আতঙ্ক

আল ইসলাম গ্রেপ্তার হলেও এলাকায় আতঙ্ক কাটছে না তার ভাই জাহাঙ্গীরের হুমকির কারণে। মিনহাজ নামে স্থানীয় এক বাড়ির মালিক জানান, আল ইসলাম গ্রেপ্তারে এলাকার মানুষের মাঝে স্বস্তি নামার কথা৷ কিন্তু বিপরীত বেড়েছে আতঙ্ক। যারা বিভিন্ন সময়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা প্রতিবাদ করেছেন, তারা যেন আল ইসলাম গ্রেপ্তারের খবরে উল্লাস না করে সেজন্য গ্রুপের সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। আগের মতোই সব কিছু চলবে বলে হুমকি দিয়েছে জাহাঙ্গীর। বলেছেন, বাড়াবাড়ি করলে হাত-পা ভেঙ্গে দেবেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাউনিয়াবাদ এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, ওদের হাত লম্বা। গ্রেপ্তার হইলে কি হইবো, আবার বের হয়ে আইবো। আল ইসলাম গ্রেপ্তারেও তো হুমকি বন্ধ নাই। তাদের লোকজন হুমকি দিতাছে। যাতে করে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারে না। আল ইসলামের সঙ্গে জাহাঙ্গীরকেও গ্রেপ্তারের দাবি করেন তিনি।