ভৌতকাঠামো নির্মাণ শেষ: আগামী বছর উৎপাদনে যাবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র

প্রকাশিত: ১০:২১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৭, ২০২৩

সেলিনা আক্তার :

ভৌত কাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে। এখন চলছে কমিশনিং। তিনটি পৃথক সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজও শেষের দিকে। সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২ হাজার ৪শ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট পরীক্ষামূলক ও বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাবে।
শনিবার (৭ অক্টোবর) ইত্তেফাককে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর। তিনি বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে আগামী বছর জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলক এবং বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে। বগুড়া ও গোপালগঞ্জে ৪শ কেভির দুইটি এবং বাঘাবাড়ির ২৩০ কেভির একটি সঞ্চালন লাইন হয়ে এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।
প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর আরও বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপন্নে যাওয়ার জন্য যেসব শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন, সেসব শর্ত পূরণ করা হয়েছে। ২ হাজার ৪শ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯০ শতাংশ। এখন রিয়েল ফুয়েল লোড করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

আগামী বছর চালু, তার আগে পরীক্ষা

কয়লা, গ্যাস বা তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো নয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র তাৎক্ষণিক চালু এবং বন্ধ করা যায় না। এ কারণে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করার আগে নানা ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পরে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর আগে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এটি চালু করতে হবে। প্রকল্প পরিচালকের ভাষ্য মতে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতিটি স্তরে যাওয়ার আগে কাজ শতভাগ সম্পন্ন কী না সেটা নিশ্চিত করে তার পর শুরু করতে হবে। তাছাড়া বাস্তবভিত্তিক জ্বালানি মজুত স্টার্টআপ, গ্রিড কানেকশন সিংক্রোনাইজেনের বিষয়গুলো নির্ভর করে অন্যান্য অবকাঠামোর ওপর। তবে আগামী বছর প্রথম ইউনিট চালু করার মতো প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

নিউক্লিয়ার ফুয়েল পুড়িয়ে যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন

পারমাণবিক চুল্লিতে ফিশান বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিউক্লিয়ার ফুয়েল পোড়ানো হয়। এ কারণে চুল্লিপাত্রে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস বিভাজন ঘটে। ফলে তাপের সঙ্গে উৎপন্ন হয় প্রচুর শক্তি। এই তাপশক্তি পানিকে বাষ্পে পরিণত করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

যেসব সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে যুুক্ত হবে বিদ্যুৎ

উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে সাতটি প্যাকেজে মোট ১ হাজার ৯৪ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ করছে দেশের বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। এই কাজের প্রায় ৮৬ শতাংশ শেষ করার কথা জানিয়েছেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশনের জন্য সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক কিউ এম শফিকুল ইসলাম।
এর মধ্যে প্রথম ইউনিট থেকে আগামী বছর বগুড়া ও গোপালগঞ্জে ৪শ কেভির দুইটি এবং বাঘাবাড়ীর ২৩০ কেভির একটি সঞ্চালন লাইন হয়ে এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।

তথ্য মতে, ১ হাজার ৯৪ দশমিক ৪১৬ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে দুই ফেজে। এর মধ্যে ৪০০ কেভির সঞ্চালন লাইন রয়েছে ৬৪৮ কিলোমিটার এবং ২৩০ কেভির সঞ্চালন লাইন রয়েছে ৪শ ৪৬ দশমিক ৪১৬ কিলোমিটার।

পাওয়ার গ্রিড জানিয়েছে, রূপপুর থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত ৬৫ দশমিক ৩১ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট লাইন, আমিনবাজার থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার, রূপপুর থেকে ঢাকা (আমিনবাজার-কালিয়াকৈর) ১৪৭ কিলোমিটার, রূপপুর থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার, রূপপুর থেকে ধামরাই পর্যন্ত ১৪৫ কিলোমিটার এবং বগুড়া পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ হচ্ছে। পদ্মা নদীতে দুইটি টাওয়ারের মাধ্যমে ৪০০ ও ২৩০ কেভির দুই কিলোমিটার লাইনসহ রিভারক্রসিং এবং যমুনা নদীতে চারটি টাওয়ারের মাধ্যমে ৪০০ ও ২৩০ কেভির সাত কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন হয়ে জাতীয় গ্রিডে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ যুক্ত করা হবে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যা পাবে বাংলাদেশ

নিউক্লিয়ার প্লান্টের বিদ্যুতে দেশের উৎপাদন শিল্পের আমূল পরিবর্তন হবে। একইসঙ্গে উৎপাদনমুখী কলকারখানার উৎপাদন হবে গুণগত মানসম্পন্ন। বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণার পাশাপাশি বহুমুখী স্মার্ট সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। তাছাড়া নিউক্লিয়ার ভিত্তিক কাঁচামাল তৈরিতেও সক্ষমতা তৈরি হবে দেশীয় কোম্পানীগুলোর।

দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশন। দেশের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার (টাকায় প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা)। মোট ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থ রাশিয়া ঋণ হিসেবে দিচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট। পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন করছে রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিভিইএল ফুয়েল কোম্পানি। ইতিমধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট প্রস্তুত হয়েছে উৎপাদনের জন্য।

বাংলাদেশ এখন ৩৩তম পরমাণু শক্তি ব্যবহারকারী দেশ

ইতিমধ্যে দুই দফায় রূপপুরে এসেছে জ্বালানি ইউরেনিয়াম। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর ইউরেনিয়ামের প্রথ চালান রূপপুরে পৌঁছে। ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করে রাশিয়া। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ ৩৩তম পরমাণু শক্তি ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় জায়গা করে। এছাড়া ৬ অক্টোবর সকালে ইউরেনিয়ামের দ্বিতীয় চালান সফলভাবে রূপপুরে পৌঁছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম উদ্যোগ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬১ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৩ সালে রাশিয়া সফরে দেশটির সঙ্গে রূপপুর প্রকল্পের ঋণ চুক্তি সইয়ের পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন (প্রথম পর্যায়) প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে। দুটি ইউনিটের মধ্যে প্রথমটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে।