মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি: কেমন যাবে ২০২৫ সাল?

প্রকাশিত: ৫:২১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫

 

নিজেস্ব প্রতিবেদক:

২০২৪ সাল ছিল আধুনিক সময়ের মধ্যপ্রাচ্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম। বছরটি পুরো অঞ্চল জুড়ে যুদ্ধ, সংঘাত, মানবিক সংকট, অর্থনৈতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণহত্যা ও ধ্বংসাত্মক ঘটনার কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে । এ বছর যত ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় সব গাজায় পরিচালিত ইসরাইলের গণহত্যা ও তাদের আগ্রাসী নীতির কারণে ঘটেছে। ইসরাইল শুধু গাজা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের প্রতিও আগ্রাসী মনোভাব প্রদর্শন করেছে। ২০২৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি কেমন ছিল, তা বুঝতে এই অঞ্চলের তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় ঘটনার বিশ্লেষণ করা দরকার।

২০২৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল গাজায় পরিচালিত ইসরাইলের গণহত্যার ধারাবাহিকতা। এ গণহত্যা ইসরাইল শুরু করেছিল। অপারেশন ‘আল-আকসা ফ্লাড’-এর প্রতিক্রিয়ায়। শুধু গাজায় বসবাসকারী নিরীহ মানুষদের জন্য নয়, বরং পুরো বিশ্বের বিবেককে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে এ ঘটনা। সবচেয়ে করুণ বিষয় হলো, গাজায় নিহতের মধ্যে বেশির ভাগই নিরীহ শিশু ও নারী। একদিকে ইসরাইল যুদ্ধ চালিয়ে গেছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সমাজ এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজার মানুষের এই দুর্ভোগ বন্ধ করার জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি । ফলে, ফিলিস্তিনি জনগণ লম্বা সময় ধরে এই চরম মানবিক সংকটে ভুগতে থাকে। ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারের সব নিয়ম ভেঙে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়ে গেছে। এটি শুধু গাজাতেই থেমে থাকেনি, বরং লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরানের মতো দেশগুলোর জাতীয় সার্বভৌমত্বও লঙ্ঘন করেছে ।

২০২৪ সালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত। এই সংঘাত শুধু দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এর প্রভাব পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ওপর পড়েছে। ইরান-নেতৃত্বাধীন ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ নামে পরিচিত গোষ্ঠীকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে ইসরাইল। গোষ্ঠীটি ইরান ও তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত, যারা দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ইসরাইল একের পর এক অভিযান চালিয়ে হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এবং সংগঠনের সব গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হত্যা করেছে। এই ধ্বংসাত্মক আক্রমণের পাশাপাশি ইসরাইল লেবাননে অবস্থানরত নিরীহ সাধারণ মানুষ ও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীকেও লক্ষ্যবস্তু হিসেবে আক্রমণ করেছে।

ইরান এই সংঘাতে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বটে, কিন্তু তারাও ইসরাইলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছে। উভয় দেশই তাদের সংঘাতের মাত্রা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সতর্ক ছিল। ইসরাইল গাজা ও পশ্চিম তীরে তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে এবং শেষ পর্যন্ত হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। পরিতাপের বিষয়, ইসরাইল বারবার এই যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করেছে।

২০২৪ সালের তৃতীয় বড় ঘটনা ছিল সিরিয়ার বিপ্লব এবং ৬১ বছরের পুরোনো বাথ শাসনের পতন। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা বহু বছর ধরে নিপীড়নের শিকার সিরিয়ার জনগণের জন্য মুক্তির বার্তা বয়ে এনেছে। সিরিয়ার সামরিক বিরোধী দলগুলো—যারা তুরস্কের নিয়ন্ত্রণাধীন নিরাপদ অঞ্চল ও ইদলিব প্রদেশে অবস্থান করছিল, মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে রাজধানী দামেস্কসহ পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয় ।

বাশার আল-আসাদ ও তার পরিবার এই বিপ্লবের পর রাশিয়ায় পালিয়ে যায়। আসাদের প্রধান দুই সমর্থক দেশ, অর্থাৎ ইরান ও রাশিয়া, সিরিয়া থেকে তাদের সেনা প্রায় সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিপ্লবের পর, অনেক দেশ নতুন সিরিয়ান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে শুরু করেছে। তুরস্ক প্রথম দেশ হিসেবে সিরিয়ায় তার দূতাবাস পুনরায় চালু করেছে এবং অন্যান্য দেশকে একই পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোও নতুন সিরিয়ান সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা শুরু করেছে।

চলতি বছর জুড়ে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। ২০২৪ সালে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেমন অপারেশন ‘আল-আকসা ফ্লাড’ এবং গাজার গণহত্যার পর, অঞ্চলটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন রূপ ধারণ করবে। তবে বিশ্ববাসী সম্ভবত গাজার চলমান গণহত্যার ঘটনায় নীরব দর্শকই হয়ে থাকবে। এটি মানবিকতা ও সহানুভূতির একটি কঠিন পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে।

ইসরাইল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্তকে বারবার অবজ্ঞা করেছে এবং এই প্রবণতা ২০২৫ সালেও চলতে থাকবে । জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ওঈঔ), এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ওঈঈ)-এর মতো বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে। তাদের কেউই ইসরাইলকে থামাতে পারেনি । এমনকি কোনো বৈশ্বিক শক্তি ইসরাইলের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তবে, ইতিমধ্যেই বহু দেশের জনগণ, এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোর অসংখ্য মানুষ, ইসরাইলের এই নির্মম কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা আশা করছেন, ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। কারণ, ইসরাইলি আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্র যত বেশি সমর্থন দেবে, তত বেশি তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ট্রাম্পের ব্যাবসায়িক মানসিকতা বিবেচনা করলে, যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে নতুন মার্কিন প্রশাসন তাদের ইসরাইলপন্থি অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। আগে যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক সংঘাত ও যুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে সাধারণত লাভবান হতো । কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, ইসরাইলের আগ্রাসী নীতি বাস্তবায়নে বিশাল সহায়তা এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় ইউক্রেনের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করার কারণে তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ইসরাইলের হাতে ফিলিস্তিনে ঘটে যাওয়া ধ্বংসাত্মক কর্মযজ্ঞের পর স্পষ্ট ধারণা করা যায়, ফিলিস্তিনি বাহিনী ইসরাইলের শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। ফিলিস্তিন-ইসরাইল প্রশ্নই মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা বা অস্থিতিশীলতার মূল নির্ধারক হয়ে থাকবে চলতি বছরব্যাপী। ফলে ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগ ও চলমান গণহত্যা মধ্যপ্রাচ্যে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের যে কোনো স্বাভাবিকীকরণ প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে। অর্থাৎ, যতদিন ইসরাইল তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ও আগ্রাসী নীতি চালিয়ে যাবে, ততদিন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক হবে না।

সিরিয়ার বিষয়ে বলতে গেলে, নতুন সরকার প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন ও দেশ পুনর্র্নিমাণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় তারা দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। সরকারের জন্য পুরো সিরিয়া পুনরুদ্ধার করতে সময় লাগবে বিশেষ করে ইসরাইলের দখল করা অঞ্চল এবং পিকেকে/ওয়াইপিজি-নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার এলাকাগুলো । শিগিরই নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ওয়াইপিজিকে নিরস্ত্র করতে এবং দেশের পুনর্গঠনে অংশ নিতে অনুরোধ করবে । যদি তারা না মানে, তাহলে নতুন সরকার তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করতে দ্বিধা করবে না। অন্যদিকে, কিছু আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তি সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং দেশে নতুন করে সহিংসতার জন্ম দিতে পারে।

২০২৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বেড়েছে। তুরস্ক ২০২৫ সালেও মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সিরিয়া ও ইরাকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তুরস্ক সিরিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সিরিয়ান বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়া আংকারা নতুন শাসনব্যবস্থাকে তাদের দেশের সমগ্র অংশ পুনরুদ্ধার ও রাষ্ট্র পুনরায় গড়ে তোলার জন্য সমর্থন দেবে।

আসাদ সরকারের পতন ২০২৫ সালে আরব বিশ্বে নতুন ধরনের আন্দোলন ও সরকার পরিবর্তনের ঢেউ তুলতে পারে। অত্যাচারী বাথ শাসনের পতন আরব অঞ্চলের ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই ঘটনা আরব বিশ্বের অন্যান্য জনগণকে তাদের নিজ নিজ স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। আর এই অনুপ্রেরণা আরব বিশ্বের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে ।

ক্স লেখক : তুরস্কের সোশ্যাল সাইন্সেস ইউনিভার্সিটি অব আংকারার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ডেইলি সাবাহ থেকে অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল মামুন