ময়মনসিংহে ডিআইজি অফিসে বৈষম্যবিরোধী পরিচয়ে হুমকি-বিশৃঙ্খলা, নেপথ্যে আওয়ামী মদদ
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী পরিচয়ে একদল শিক্ষার্থী ময়মনসিংহ ডিআইজি অফিসে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ৬ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের এ রকমের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটি নিজের ফেইসবুক আইডিতে শেয়ার করেছেন ময়মনসিংহ (সদর)-৪ আসনের আওয়ামী লীগের পলাতক সাবেক সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান শান্ত। এ ঘটনায় জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনসহ সর্বস্তরে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
বুধবার (১ জানুয়ারি) দুপুরে এই ভিডিওটি শেয়ার করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত শহীদ সাগর হত্যা মামলার পলাতক আসামি ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান শান্ত। ভিডিওটির সঙ্গে তিনি লেখেন, ‘আমাদের ময়মনসিংহের ডিআইজি সাহেবের সঙ্গে মেধাবীদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময়।’
সেই ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, শিক্ষার্থীরা বলছেন, আপনি (ডিআইজি) প্রতি সপ্তাহে কেন বাড়িতে যান, তারাকান্দার ওসি আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ময়মনসিংহে নিহত রেদুয়ান আহমেদ সাগর হত্যা মামলার আসামিরা কেন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ সময় ডিআইজি ড. আশরাফুর রহমানের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাদানুবাদ করতে দেখা যায়।
ভিডিওতে দেখা যায়, অফিসে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে স্লোগান দিতে দিতে ডিআইজির কক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ করতে দেখা যায়।
এদিকে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ডিআইজি কক্ষে এভাবে দিন-দুপুরে শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধামকির বিষয়টি নিয়ে হতবাক পুলিশসহ ময়মনসিংহের সরকারি কর্মকর্তারা। এ নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত সাধারণ মানুষও। তবে গত ২৮ ডিসেম্বর দুপুর বারোটার দিকে ডিআইজির অফিসে এই অপ্রীতিকর ঘটনা সংগঠিত হলেও এখনো ময়মনসিংহের পুলিশ ওই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে সাহস পাচ্ছে না।
এই বিষয়ে ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। এ ঘটনায় ফ্যাসিবাদী চক্রের ইন্ধন রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া গেছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কর্মী, জেলা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, গত ২৭ ডিসেম্বর রাতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হয় মহানগর জাসদের সভাপতি, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মী সাগর হত্যা মামলার আসামি সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু। এ ঘটনায় ওইদিন রাতেই তাকে ছাড়াতে থানায় যান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মী পরিচয়ে একদল শিক্ষার্থী। এ সময় তারা ওই কাউন্সিলরকে ছাড়তে পুলিশকে চাপ দেয়। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়া কাউন্সিলর মিন্টু সাগর হত্যা মামলার এজহারভুক্ত আসামি হওয়ায় তাকে ছাড়তে পুলিশ অপারগতা প্রকাশ করায় তারা ক্ষুব্ধ হয়। মূলত ওই ঘটনার জের ধরেই পরদিন ২৮ ডিসেম্বর ওই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ডিআইজি অফিসে গিয়ে তান্ডব তৈরি করে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একটি সূত্র জানায়, ডিআইজি অফিসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী শিক্ষার্থীরা সমন্বয়ক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং সাবেক শিবির নেতা মেহেদী হাসান তারেকের সহযোগী। তাদের মধ্যে অনেকেই ছাত্রলীগের বর্তমান পদধারী এবং ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী রয়েছে। তারা এর আগে বিআরটি অফিসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তারা। সদর উপজেলার অফিস কর্তার সঙ্গে বেয়াদবিসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে।
এর মধ্যে ডিআইজি অফিসে বিশৃঙ্খলার নেতৃত্বদানকারীরা হলেন- ছাত্র সমন্বয়ক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সহযোগী সাইবে রাকাত, আল নূর আয়াশ, ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা মাহাদী হাসান তারেক, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কর্মী মেহেদী হাসান সিয়াম, ময়মনসিংহ মহানগর ছাত্রলীগের ওয়ার্ড শাখার সহ-সভাপতি সাকিব হাসান রিমন, ছাত্রলীগকর্মী রোহান, অলি উল্লাহ, হৃদয় ও ছাত্রদল কর্মী রাকিবুল ইসলাম ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কর্মী নিহাল।
এ বিষয়ে ছাত্র সমন্বয়ক ও গণঅধিকার পরিষদের সাবেক নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সমকালকে বলেন, ‘যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছিল, তারা সবাই আমাদের লোক। তাদের সঙ্গে আন্দোলন করেছি, চলাফেরা উঠাবসা করি। তবে ডিআইজি অফিসে আমি যাইনি। সেখানের ঘটনার দায়ভার আমার না, ওই ঘটনার ভালোমন্দের দায় তাদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘কাউন্সিলর মিন্টুর দুই ছেলে আমাদের সঙ্গে আন্দোলন করেছে। তাই তার বাবা গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাকে জানালে আমরা কয়েকজন থানায় গিয়েছিলাম, কী অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানতে। আমি তাকে ছাড়াতে যাইনি। তবে আমার অনুরোধ ছিল, তার সঙ্গে যেন অন্যায় না করা হয়।
ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা মাহাদী হাসান তারেক বলেন, আমি এই ঘটনার কিছু জানি না। তবে ছেলেরা ডিআইজি অফিসে গিয়েছে, এমন খবর পেয়ে আমি তাদের ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলাম।
তবে জামায়াত ও শিবিরের একাধিক নেতা বলেন, মাহাদী হাসান তারেক আগে শিবিরের সাথী ছিল। তবে এখন সঙ্গে শিবিরের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।
ঘটনাটি অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বলে দাবি করেছেন ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক গোকল সূত্রধর মানিক বলেন, শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এ ধরনের ঘটনা কখনোই কাম্য নয়। এটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনাবিরোধী কাজ। আমি চাই, ঘটনা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
অভিযোগ উঠেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নাম ভাঙ্গিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদীর কিছু দোসর সাবেক এমপি শান্ত, সাবেক সিটি মেয়র টিটু ও পরিবহন মাফিয়া আমিনুল হক শামীমের গোপন ইন্দনে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা পুলিশ প্রশাসনকে চাপে রেখে আওয়ামী জনপ্রতিনিধি ও দোসরদের গ্রেপ্তার ঠেকাতে এই কান্ড ঘটিয়েছে।
এই বিষয়ে ডিআইজি ডক্টর আশরাফুর রহমান বলেন, ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত। এটি আন্দোলনের চেতনাবিরোধী কাজ। মূলত আওয়ামী দোসরদের ইন্দনে একটি গ্যাং এর আগেও বিভিন্ন সরকারি অফিসে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছে। এটা কাম্য নয়।
ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার (এসপি) আখতার উল আলম জানান, আমি এই জেলায় নতুন জয়েন করেছি। ডিআইজি অফিসের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। এদের পেছনে কারা জড়িত এবং কি উদ্দেশ্য এটা ঘটিয়েছে, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। দায়ীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।