
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:
জলবায়ু পরিবর্তন, অকালবন্যা, ফসলি জমির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং সেচ সংকট– এ ধরনের কোনো না কোনো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রতি মৌসুমে বোরো আবাদ করেন সুনামগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চলের কৃষকরা। চলতি মৌসুমেও বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলছে বিভিন্ন জাতের বোরো ধানের আবাদ। ধান উৎপাদনে জেলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এলাকা তাহিরপুরে মাজরা পোকার আক্রমণে দিশেহারা কৃষক।
জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে বোরো ও আমন উৎপাদনে ধারাবাহিক সাফল্যের দেখা পেয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিশ্চিতে চলতি মৌসুমে নির্ধারিত সময়ে বোরো চাষ শুরু করা হয়। জমিতে ধানের শীষ দেখে এবারও বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখছিলেন স্থানীয় কৃষকরা। কিছুদিনের মধ্যে জমির ধান গোলায় ওঠার কথা তাদের। ঠিক এমন সময় মাজরা পোকার আক্রমণে আশাহত প্রান্তিক কৃষকের বড় একটি অংশ। এ পোকার আক্রমণের ফলে ধানের পাতা পোড়া রোগের বিস্তার ঘটছে ফসলের জমিতে।
বোরো জমিতে মাজরা পোকার আক্রমণ আর পাতা পোড়া রোগের হানায় সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠিত উপজেলার শনির হাওরপারের কৃষকরা। ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কায় তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। কৃষকরা বলছেন, বৃষ্টি না হওয়ায় হাওরাঞ্চলের জলাধারগুলোতে পানি নেই। কৃত্রিম সেচের সুব্যবস্থা না থাকায় জমিতে পর্যাপ্ত পানি নেই, যার কারণে মাজরা পোকার আক্রমণে ধানের পাতা পোড়া রোগের বিস্তার ঘটছে। এতে প্রত্যাশিত ফলন পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত তারা।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোর ধানের আবাদ করা হয়েছে। বিএডিসির বীজ ডিলার সামায়ুন কবীর জানান, এ বছর হাওরে ব্রি-১২০৩, ১২০৫, ৬৭, ৯২, ২৮, ২৯, ব্র্যাকের শক্তি-২, ৩, ৭৭, মিতালি-৪, কৃষিবিদ-১, ঝনকরাজ, সুরভী-১ ও ব্যাবিলন-২ জাতের ধান চাষ করেছেন কৃষকরা।
স্থানীয় বোরোচাষিরা জানান, মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বোরো ধানের ভালো ফলনের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন কৃষক। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় প্রাকৃতিক উৎসে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হয়। কৃত্রিম সেচের সুব্যবস্থা না থাকায় সংকট বাড়ে। শুরু হয় মাজরা পোকার আক্রমণ; ধানের পাতা পোড়া রোগের বিস্তার। শুরুর দিকে ধান পাতার কিনারা ও আগায় ছোট ফ্যাকাসে ছাপ পড়তে দেখা যায়। ধীরে ধীরে সেগুলো বড় হয়ে পাতার দু’প্রান্ত দিয়ে ভেতরের দিকে অগ্রসর হয়ে আক্রান্ত অংশ বিবর্ণ হচ্ছে এবং ধূসর বাদামি বর্ণে পরিণত হচ্ছে। পোকার আক্রমণে এ সমস্যার শুরু হয়, যা শেষ পর্যন্ত পাতাপোড়া রোগে রূপ নেয়। অনেক জমিতে ধানের পাতা কুঁচকে যাচ্ছে। কচি পাতা বাদামি বর্ণ ধারণ করছে। কীটনাশক ছিটিয়েও তেমন সুফল মিলছে না। এতে করে যেমনটা আশা করা হচ্ছিল, তেমন ফলন না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সামগ্রিকভাবে এবার ধানের উৎপাদনে ভাটা পড়বে।
উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামের কৃষক সেলিম আখঞ্জি জানান, বোরো ধানের এই রোগে পাতা ঝলসে যায়। এ কারণে এর নাম পোড়া রোগ দেওয়া হয়েছে। মাঠজুড়ে এ রোগের বিস্তার ঘটায় বোরোচাষিরা এবার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সাধারণত কিয়ারপ্রতি (৩০ শতকে এক কিয়ার) ২০ মণ ধান হয় এখানকার জমিতে। মাজরা পোকার আক্রমণে ছড়িয়ে পড়া পোড়া রোগের কারণে প্রতি কিয়ারে ১৫ মণ ধান পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে কৃষকদের। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় অধিকাংশ জমির ধান এ রোগে আক্রান্ত। এ ছাড়া ধানগাছের মাঝের অংশ ও পাতায় কাটা দাগ দেখা যাচ্ছে, যা মাজরা পোকার আক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করে।
ভাটি তাহিরপুর গ্রামের কৃষক আলমগীর খোকন বলেন, অনাবৃষ্টির কারণে হাওরে তাঁর সাত কিয়ার জমির ধান মাজরা পোকার আক্রমণে নষ্ট হচ্ছে। ধানগাছের মধ্যভাগ কাটা দেখা যাচ্ছে, যা এই পোকার আক্রমণের লক্ষণ। এতে প্রতিটি শীষে থাকা ধানগুলো চিটায় পরিণত হচ্ছে। অথচ আর কিছুদিনের মধ্যে ধান গোলায় তোলার কথা তাদের।
উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, কৃষকরা মাজরা পোকার আক্রমণ এবং পোড়া রোগের বিস্তারের কথা জানিয়েছেন। পোকা দমনে বিত্তাকু কীটনাশক জমিতে ছিটিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, শুরু থেকে গরমের প্রভাব বেশি। সে জন্য গাছে ফুল আসার সঙ্গে সঙ্গে ধানগাছের গোড়ায় পানি রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল কৃষকদের। তবে হাওর এলাকায় কৃত্রিম সেচের সুব্যবস্থা না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দিনে কাঠফাটা রোদ আর রাতে ঠান্ডা। এমন অস্বাভাবিক আবহাওয়া ধানের জন্য ক্ষতিকর।