মাদক নির্মূলে নতুন চ্যালেঞ্জ ‘ডার্ক ওয়েব’

প্রকাশিত: ১:৪৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৩
dark web hooded hacker security concept

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাইবার জগতে বাড়ছে অপরাধের মাত্রা ও ধরন। বিশেষ করে, বহুল পরিচিত ‘প্রকাশ্য’ ইন্টারনেটের মাধ্যমের আড়ালে গড়ে উঠেছে বিশাল এক ‘অন্ধকার জগৎ’; যা ‘ডার্ক ওয়েব’ নামে পরিচিত। বিভিন্ন ধরনের অপরাধী এখানে নিজেদের পরিচয় গোপন করে ‘গুরুত্বপূর্ণ নথি’, ‘শিশু পর্নোগ্রাফি’, ‘অস্ত্র’ ও ‘মাদক’সহ নানা ধরনের অবৈধ জিনিসপত্র কেনাবেচা করে থাকে। ইন্টারনেট জগতের এই অবৈধ বা অপরাধ কর্মকাণ্ডের মার্কেটপ্লেসই এখন দেশের মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তদের অন্যতম ভরসাস্থল। এটি এমন এক পর্যায়ে গেছে যে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ (ডিএনসি) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে রীতিমতো ‘মাথাব্যথার কারণ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা বলছে, ইন্টারনেট-ভিত্তিক সংযোগ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের দ্রুত প্রসারকে মাদকপাচারকারী ও মাদক ব্যবহারকারীরা হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। ডার্ক ওয়েবের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে— ক্রেতা-বিক্রেতার পরিচয় গোপন রাখা। এতে অপরাধীদের ধরা পড়ার ঝুঁকিও কম থাকে। সে কারণেই অবৈধ মাদক বাণিজ্য ও অর্থপাচারের জন্য ডার্ক ওয়েব পাচারকারীদের কাছে জনপ্রিয়।

ডিএনসি সূত্র বলছে, ‘ক্লিয়ার ওয়েব’ ও ‘ডার্ক ওয়েব’; দুই প্লাটফর্মেই বিভিন্ন স্তরে মাদক কেনাবেচা চলছে। মাদক ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীরা সম্ভাব্য ঝুঁকি ও অসুবিধাগুলো মূল্যায়ন করে ঘন ঘন এই প্ল্যাটফর্মগুলো পাল্টে থাকে।

এর মধ্যে ‘ক্লিয়ার ওয়েব’— যা সচরাচর সবাই ব্যবহার করে থাকেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ; যেখানে ব্যবহারকারীর পরিচয় জানা যায় এবং পরিচয় না থাকলেও সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এসব মাধ্যম ব্যবহার করেও অনেকেই মাদক কিংবা জাল টাকাসহ নানা ধরনের অবৈধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

আর ডার্ক ওয়েবে ব্যবহারকারীদের পরিচয় শনাক্ত করা সহজে সম্ভব হয় না। তবে বিশেষ ‘মনিটরিং টুলস’ ব্যবহার করে এই ডার্ক ওয়েবেও নজরদারি করা যায়। দেশের অনেক অপরাধী এখন ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করে। অথচ কয়েকটি বিশেষ সংস্থা ছাড়া সব আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ডার্ক ওয়েব মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এ কারণে প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকলেও মনিটরিং টুলস না থাকায় মাদকসহ নানা ধরনের অবৈধ কাজ যারা করছে; তারা অনেকাংশেই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ডিএনসির কয়েকটি অভিযানে বেশ কয়েকজন গ্রেফতারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করে মাদক ব্যবসা পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে। বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন মাদক কেনার জন্য তারা এই মাধ্যম ব্যবহার করছে।

২০২২ সালের ৫ জুলাই রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ভয়াবহ মাদক এলএসডি-সহ নাজমুল ইসলাম নামে একজনকে গ্রেফতার করে ডিএনসি। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে তদন্ত করে ডিএনসির কর্মকর্তারা জানতে পারেন, সে মূলত ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করে মাদক সংগ্রহ করতো। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করতো।

এ ছাড়া খুলনায় অভিযান চালিয়ে ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর আরেক অপ্রচলিত মাদক ডিওবিসহ আসিফ আহমেদ ও অর্ণব কুমার শর্মা নামে দুই জনকে গ্রেফতার করে ডিএনসি। পরে ঢাকা থেকে তাদের আরেক সহযোগী একটি কুরিয়ার সার্ভিসের সদস্য মামুনুর রশীদকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনার তদন্তেও উঠে আসে ডার্ক ওয়েবের সংশ্লিষ্টতা।

গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যেন ধরা না পড়তে হয়, সেজন্য তারা অনেক ক্ষেত্রেই এসব অবৈধ কাজের জন্য ডার্ক ওয়েবের সহায়তা নিচ্ছে। আর এই মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে।

জানা গেছে, ডিএনসি ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মাদক সম্পর্কিত মানি লন্ডারিংয়ের (এমএল) তদন্ত করছে। ডিএনসি ইতোমধ্যে মাদক সম্পর্কিত আর্থিক অপরাধের তদন্তও শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত তিনটি মামলা করা হয়েছে, মামলাগুলো ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধমূলক আইন, ২০১২ (সংশোধিত ২০১৫)’ অনুসারে তদন্তাধীন রয়েছে।

মামলাগুলোর তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, গ্লোবাল কানেক্টিভিটি ও ডিজিটাল অর্থ লেনদেনের কারণে এসব অপরাধের তদন্তে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পাশাপাশি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) কর্মকর্তাদেরও বেগ পেতে হচ্ছে। এর মধ্যে ডার্ক ওয়েবের এনক্রিপশন কৌশল ও নাম প্রকাশ না করার কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে ডার্ক ওয়েবের কার্যক্রমও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএনসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ দুটি সক্রিয় মাদক উৎপাদনকারী অঞ্চলের মাঝে অবস্থিত— সেগুলো হলো ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ এবং ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’। এই ভৌগোলিক নৈকট্য আমাদের দেশকে মাদকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আমাদের দেশে মাদক পাচার হয়। বাংলাদেশের তিন দিকে (পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব) ভারতের সঙ্গে ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার (কিমি) স্থলসীমান্ত রয়েছে। আর মিয়ানমারের সঙ্গে রয়েছে ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত (ভূমি ও নদী)। এ ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৫৮ কিলোমিটার সমুদ্রসীমা রয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফদরের উপপরিচালক রাশেদুজ্জামান খান বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। অনলাইন ও অফলাইন সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই কর্মকর্তারা মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ডার্কনেট বা ডার্ক ওয়েবসাইটগুলোতেও এখন নজরদারি চালানো হচ্ছে।’

মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে মাদক কারবারীদের নিত্য নতুন কৌশল ভেদ করে অধিদফতরের কর্মকর্তা এবং সদস্যরা সারা দেশে কাজ করছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সূত্র-বাংলাট্রিবিউন।