মানুষ যখন পশু হয়ে যান তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয় : আদালত

প্রকাশিত: ২:৩৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৯, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:

একজন মানুষ যখন পশু হয়ে যান তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়। গণপিটুনির নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হলে তা এ সমাজের যেকোনো মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন আদালত।

বুধবার (৯ অক্টোবর) ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত-৬ এর বিচারক মোহাম্মদ মোরশেদ আলম রেণু হত্যা মামলায় দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেন।

বিচারক বলেন, গণপিটুনির নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হলে তা এ সমাজের যে কোনো মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।

পাঁচ বছর আগে রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেণুকে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় ১ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ৪ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও ১ বছরের কারাভোগ করতে হবে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন। আসামিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত জরিমানার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দিয়ে বাকি টাকা মামলার বাদী তথা নিহত রেণুর পরিবারকে দেওয়ার আদেশ দেন আদালত।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন, ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- রিয়া বেগম ময়না, আবুল কালাম আজাদ ওরফে আজাদ মন্ডল, কামাল হোসেন ও আসাদুল ইসলাম।

এদিন বেলা ১১টা ১০ মিনিটে আদালত চাঞ্চল্যকর এ হত্যার মামলার রায় পড়া শুরু করেন। শুরুতে বিচারক বলেন, এটা একটা চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। ভাগ্যক্রমে আমিই রায় পড়ছি।

এ মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও ফুটেজ। এটা না থাকলে রায়ের দিকে যাওয়াটা কঠিন হতো। চারটি ভিডিও ক্লিপ। আমি দেখাতে চাই। পরে আদালত ৫ মিনিট করে দুটি ভিডিও ক্লিপ আদালতে দেখান। ভিডিও দেখে আদালতে কাঁদে দেখা যায় রেনুর বোন নাজমুন নাহার নাজমাকে।

এর মাঝে বিচারক বলেন, আবুল কালাম কে? তখন হাত তোলেন আবুল কালাম। বিচারক বলেন, দেখছেন আপনাকে। আবুল কালাম বলেন, দেখা যায়নি।

কালামকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, আপনি দেখেন তো কি করছেন।

কামাল বলেন, আমি সবাইকে বলেছি থামো। দয়া করে থামো। শোনো সে কি বলতে চায়। আমরা শুনতে চাই। কিন্তু কেউ শোনে না।

এরপর বিচারক বলেন, তদন্তে কিছু দুর্বলতা আছে।

ইব্রাহিমকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, দেখবা তোমাকে চিনতে পারো কি না।

ভিডিও দেখা শেষ হলে বিচারক বলেন, বেশির ভাগই একজন মেরেছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে সন্দেহ নেই।

রায় পড়ার সময় বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, কেস ডায়েরি পর্যালোচনা করে দেখা যায় আসামিরা আইন-কানুনের পরোয়া করেননি। আসামি ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা লাঠি দিয়ে নিহতের দুই হাতে, কাঁধে, বুকে, উরু ও পায়েসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেন এবং মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে আঘাত করতে থাকেন।

রেণুকে হত্যা বীভৎস, নারকীয় ও নৃশংস ছিল। যেভাবে গণপিটুনি দিয়ে তসলিমা বেগম রেণুকে হত্যা করা হয়েছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং সমাজের প্রত্যেক মানুষের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

আসামি ইব্রাহিম কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া নিষ্ঠুর ও বর্বরভাবে আঘাত করে একজন স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাকে হত্যা করেছেন এবং দুই শিশুকে মাতৃহারা করেছেন। নিজের পশু মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ করেছেন। তার পূর্ব অপরাধ ও শাস্তির রেকর্ড নেই কিন্তু নিহতকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করায় তাকে লঘু শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই।

অপরাধ সংগঠনের সময় তিনি যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, উন্মত্ততা, ও পৈশাচিকতা প্রদর্শন করেছেন সেক্ষেত্রে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া সমীচীন হবে না। সংগঠিত আপরাধের মাধ্যমে তিনি নিজেকে সমাজে কলঙ্কিত করেছেন। একজন মানুষ যখন পশু হয়ে যান এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কলঙ্কে পরিণত হয়ে যান তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়।

দীর্ঘ এক ঘণ্টা রায় পড়া শেষে বিচারক এজলাস থেকে নেমে যান। এদিন কারাগার থেকে আসামি ইব্রাহিমকে আদালতে আনা হয়। অপর আসামিরা জামিনে ছিলেন তারাও আদালতে হাজির হন। রায় ঘোষণা শেষে সাজা পরোয়ানা দিয়ে তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।

এসময় আসামি ইব্রাহিম অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে কারাগারে যেতে চাচ্ছিলেন না। বোনকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, আমার তো ফাঁসি হয়ে গেছে। আজই ফাঁসি দিবো। তখন অন্যান্য দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের স্বজনদেরও কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।

এদিকে রেণুর দুই সন্তান ছেলে তা-সীন আল মাহির ও মেয়ে তাসমিন মাহিরা তুবা আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করেছিলেন। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ছেলে তা-সীন আল মাহির বলেন, এ রায় নিয়ে আমরা প্রতীক্ষায় ছিলাম। আমরা আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করেছিলাম। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট না।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২০ জুলাই রাজধানীর বাড্ডার একটি স্কুলে সন্তানদের ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হন তাসলিমা বেগম রেনু। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ৫০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন রেনুর ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু।

পরে ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আদালতে ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আব্দুল হক। এছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক দুজনের বিরুদ্ধে দোষীপত্র দাখিল করেন। এই দুই শিশুর মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-৭ এ বিচারাধীন রয়েছে।

২০২১ সালের ১ এপ্রিল ১৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার ৬ষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ফাতেমা ইমরুজ কনিকা।

মামলাটিতে আদালত চার্জশিটভুক্ত ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন। এরপর আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন ও রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের তারিখ ধার্য করা হয়।