ডেস্ক রিপোর্টঃ
শিক্ষাক্রমের অংশ নয়, এমন কিছু বিষয়ের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েও মিথ্যাচার করা হচ্ছে।‘মাঠ পর্যায়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সমস্যা রয়েছে’– এর বেশি সমালোচনা করেননি শিক্ষাবিদরা। কিন্তু অভিভাবকসহ একটি শ্রেণি নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করছেন, অনেকে করছেন বিষোদগারও। ঘটনা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বুঝতে না পেরে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হতে পারেন, কিন্তু মিথ্যাচারের অর্থ কী? অভিভাবকরা কি মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছেন? নাকি স্বার্থান্বেষী কোনও গোষ্ঠী এটি করছে? কী কারণে এত অপপ্রচার ও বিরোধিতা? জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে— নতুন শিক্ষাক্রম শুরু করার ঘোষণা দেওয়ার সময় থেকেই বিরোধিতা করা হচ্ছে। জাতীয় সংসদে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এর বিরোধিতা করা হয়েছে। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হলে অভিভাবকদের উসকানি দেওয়া হয়েছে এর বিরোধিতা করতে। অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করতে নানা মিথ্যা তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিরও চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যাঙের লাফ বা হাঁসের ডাক কিংবা ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, কোনও কিছুই বাদ যায়নি মিথ্যাচার করতে। প্রসঙ্গত, আগের শিক্ষাক্রম যা এখনও চলমান তার সমালোচনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। এরপর ২০২২ সালের নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হলে সমালোচনা শুরু হয়। প্রথম সমালোচনা শুরু হয় ধর্ম বই থাকছে না বলে। ২০২৩ সালে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণিতে এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হলে নতুন করে সমালোচনা তীব্র আকার ধারণ করে। ২০২৩ সালে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ্যবই নিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়। ফলশ্রুতিতে বিবর্তনবাদসহ কিছু বিষয় ভুল না থাকলেও অপসারণ করা হয়। তাতেও সমালোচনা থামেনি। বরং মিথ্যাচার শুরু হয়। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন ভিডিও বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ হিসেবে প্রচার চলতে থাকে। এর একপর্যায়ে গত ৩ ডিসেম্বর এনসিটিবি সতর্ক করে দিয়ে মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তি দেয়। মিথ্যাচারের জন্য সম্প্রতি তিন জনকে গ্রেফতারও করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ব্যাপকভাবে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। যেগুলো আমাদের প্রশিক্ষণের অংশ নয়, সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠী স্বার্থহানি হওয়ার ভয়ে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে। যাদের স্বার্থহানি হচ্ছে তারা বিরোধিতা করছে। তাছাড়া নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকে, তাদের উসকানি যুক্ত হয়ে গেছে। অতি-ডান, অতি-বামের উসকানিও যুক্ত হয়ে গেছে। সবচেয়ে খারাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে মিথ্যাচার। এমনকি ধর্মীয় বিষয় নিয়েও মিথ্যাচার করছে। যেগুলো আমাদের শিক্ষক প্রশিক্ষণের অংশ নয়, ক্লাসের অংশ নয়, নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ নয়, তেমন নানান রকমের ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। অতীতের কোনও প্রশিক্ষণের বিরতির সময়ের বিনোদনের অংশ, যা মাধ্যমিকের নয়, সেরকম অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে এগুলো প্রশিক্ষণ। এমনকি নতুন ভিডিও তৈরি করেও ছড়িয়ে দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান বলেন, ‘প্রথম দিকে বিরোধিতাকারীরা যে অ্যাপ্রোচ নিয়েছিল তা হচ্ছে—শিক্ষাক্রমের ভুল কিছু ধরা যায় কিনা? নানা যুক্তি দিয়ে ভালনারেবল অবস্থায় নেওয়া যায় কিনা? তাদের সেই চেষ্টার পর আমরা যখন ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করলাম, শিক্ষামন্ত্রীও ব্যাখ্যা করেছেন, তখন তারা ভিন্ন অ্যাপ্রোচে চলে গেলো। মিথ্যাচার ছাড়াও অনেক ডাইমেনশন রয়েছে। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, শিক্ষকদের বিরোধিতায় নেওয়া যায় কিনা, মানুষের কাছে খেলো হিসেবে শিক্ষাক্রমকে উপস্থাপন করা যায় কিনা? এসব উদ্দেশ্য নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে। কোচিং সেন্টার, গাইড বইয়ের একটি বিষয় আছে, পাশাপাশি সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পলিটিক্যাল ইস্যু করা যায় কিনা এসব কারণে মিথ্যাচার, অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এটা খুব দুঃখজনক, একটি শিক্ষাক্রম দিয়ে জাতির ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হবে সেটাকে খেলো বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটাই প্রমাণ করে একটি নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা দরকার।’ এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষাক্রম নিয়ে সাধারণের অজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু সে কারণে মিথ্যাচার করা হচ্ছে তা নয়। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এমনকি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। নতুন শিক্ষাক্রম ও ইংরেজি মাধ্যমের সমালোচনা করা হলেও সাম্প্রদায়িক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে কোনও সমালোচনাও করা হয়নি। এর মধ্যে রাজনীতি আছে। আমরা তো বলেছি, ভুল থাকলে তা সংশোধন করা হবে। গঠনমূলক সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু মিথ্যাচার কেন? মিথ্যাচার শুধু বিরোধিতার কারণে।’ নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ২০২৩ সাল থেকে, পুরোপুরি বাস্তবায়ন শেষ হবে ২০২৭ সালে। প্রথম থেকে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করতে সময় লাগবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। তবে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হতে না হতেই বিরোধিতা শুরু হয়েছে। এনসিটিবি জানায়, স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী সম্প্রতি নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন ও ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনমনে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে বা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ পরিপন্থি কাজকে শিক্ষাক্রমের কাজ বলে প্রচার করা হচ্ছে। নবীর ছবি আঁকতে বলা হয়েছে– এরকম লিখে মিথ্যাচার করছে। হিন্দি গানের সঙ্গে স্কুলের পোশাক পরা কিছু ছেলেমেয়ে ও ব্যক্তির অশ্লীল নাচ আপলোড করে, কিছু লোক ব্যাঙের লাফ বা হাঁসের ডাক দিচ্ছে এমন ভিডিও আপলোড করে বলা হচ্ছে এটা নতুন শিক্ষাক্রমের শিক্ষক প্রশিক্ষণের অংশ, যা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। এনসিটিবি জানায়, শিক্ষাক্রমের কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা আমাদের জানালে আমরা অবশ্যই তা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধন পরিমার্জন করবো। কিন্তু অপপ্রচার করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের উদ্দেশ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার সব ধারাকে বিবেচনা করে প্রথমবারের মতো জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা- ২০২১ প্রণয়ন করা হয়। এই রূপরেখা প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে বিস্তারিত শিক্ষাক্রম, শিখন, শেখানো সামগ্রী এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়া প্রণয়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ হয়। শিক্ষাক্রম প্রণয়নের আগে ২০১৭-২০১৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ৮টি গবেষণা পরিচালনা করে তার ভিত্তিতে এই রূপরেখা প্রণয়ন করে। শিক্ষাক্রমের মূল স্পিরিট হচ্ছে—সংবেদনশীল, জবাবদিহিমূলক, একীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞান, যোগ্যতা, মূল্যবোধ ও দক্ষতা বাড়াতে জাতীয় শিক্ষাক্রমের মূল ভিত্তি ঠিক করা হয় জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখায়। যোগ্যতা নির্ধারণে শিক্ষার্থীদের প্রেরণা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করা হয়েছে।