সিলেট প্রতিনিধি:
ছোট্ট মুনতাহার মায়াভরা চোখ, পরনে গোলাপি জামা, ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক; মাথায় এলোমেলো চুল। হাস্যোজ্জ্বল মায়াবী মুখ অপলক তাকিয়ে। ৩ নভেম্বর নিখোঁজ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ৬ বছরের ফুটফুটে শিশুটির ছবি। দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই তার সন্ধান পেতে প্রার্থনা করেন। কেউ কেউ তার সন্ধানদাতাদের জন্য ঘোষণা করেন পুরস্কারও।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েক দিন ধরে নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে সিলেটের কানাইঘাটের বীরদলের ভাড়ারিফৌদ গ্রামের মুনতাহা আক্তার জেরিন সবার হৃদয়ের গহিনে জায়গা করে নিয়েছিল। ফিরে এসে আনন্দমাখা মুখে মা-বাবার কোলে ঝাঁপ দেবে– এমন দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় ছিল সবাই।
অবশেষে মুনতাহার খোঁজ মিলল, তবে তা সবাইকে অশ্রুসিক্ত করে। নিখোঁজ হওয়ার সাত দিন পর পুলিশ জানাল, মুনতাহাকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। লাশ উদ্ধারের সময় শিশু মুনতাহার শরীরে কাদা লেগে ছিল। কচি-নরম গলায় পেঁচানো ছিল রশি জাতীয় কিছু। এতে সন্দেহ করা হচ্ছে, শ্বাসরোধে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলো– মুনতাহার প্রতিবেশী শামীমা বেগম মার্জিয়া, তার মা আলিফজান বেগম, প্রতিবেশী নাজমা বেগম ও ইসলাম উদ্দিন। আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়া হয়েছে। তবে তাদের নাম-পরিচয় জানায়নি পুলিশ। মুনতাহাকে পড়াত মার্জিয়া। কয়েক মাস আগে শিশুটির বাসায় চুরির অভিযোগে মার্জিয়াকে বাদ দেওয়া হয়।
সিলেট জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় শনিবার মুনতাহার বাবা বাদী হয়ে কানাইঘাট থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অপহরণ মামলা করেন। মামলার পর শনিবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মার্জিয়াকে আটক করে পুলিশ। এর পর তাকে নেওয়া হয় থানায়। আটকের পরপরই রোববার ভোরে তার ঘরের পাশের ছোট্ট ডোবায় পুঁতে রাখা মুনতাহার লাশ নিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সময় প্রতিবেশীদের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে মার্জিয়ার মা। এর পরই চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা এলাকায় জানাজানি হয়।
প্রতিবেশী আব্দুল ওয়াহেদ সমকালকে বলেন, ‘শনিবার রাত আনুমানিক ১২টার দিকে মার্জিয়াকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এর পর মুনতাহার বাবা, চাচাসহ আমরা কয়েকজন থানায় যাই। এ সময় পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, আপনারা মার্জিয়ার মা আলিফজানের বাসার আশপাশে ঘুরে আসুন। রাতেই আমরা লাইট মেরে আশপাশে খোঁজার পর কিছু পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘আড়াইটার দিকে বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। বাড়ি ফেরার পথে দেখি মার্জিয়ার মা ঘরের বাইরে চেয়ারে বসে আছে। ৩টার সময় একজন মহিলা কেন বাইরে বসে থাকবে– এটা দেখে সন্দেহ হলো। বাড়িতে এসে গায়ের জামা বদল করলাম। এর পর ঘরে-বাইরের লাইট বন্ধ করি। কালো চাদর গায়ে দিয়ে একটি টর্চ নিয়ে মুনতাহাদের বাড়ির দিকে রওনা হই। পথিমধ্যে টর্চ মেরে দেখি কাদায় ভরা মুনতাহাকে নিয়ে পুকুরপাড়ে হাজির মার্জিয়ার মা। তখন চিৎকার দিয়ে বলি, ‘মুনতাহাকে মেরে ফেলেছে।’ এর পর লোকজন জড়ো হয়। ভোরে ক্ষুব্ধ লোকজন আলিফজানের ঘরটি পুড়িয়ে দেয়। মার্জিয়ার কাছে একাধিক মোবাইল ফোনের সিমকার্ড পাওয়া গেছে।
আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, নিখোঁজের দিন রোববার আমার বাড়িতে খেলা করছিল মুনতাহা। আমাদের বিশ্বাস ছিল, শিশুটিকে জীবিত পাব। কিন্তু তাকে হত্যা করা হবে; ঘরের পাশেই তার মরদেহ মিলবে– কল্পনাও করিনি।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, গ্রেপ্তার মার্জিয়াসহ চারজনকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মার্জিয়ার প্রাথমিক ভাষ্য, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মুনতাহার প্রতিবেশীরাও জড়িত। জমিজমা ও যাতায়াতের রাস্তা নিয়ে ওই প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিরোধ ছিল মুনতাহার পরিবারের। এর জেরে মার্জিয়াকে ব্যবহার করে নৃশংস এ ঘটনা ঘটানো হয়। তবে এ হত্যাকাণ্ডে মুনতাহার প্রতিবেশীদের জড়ানোর বিষয়টি মার্জিয়ার কৌশল কিনা, তা আরও যাচাই-বাছাই করে দেখছে পুলিশ। শিশুটির যে দুই প্রতিবেশীর নাম মার্জিয়া বলেছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ। তবে চুরির অভিযোগে মার্জিয়াকে প্রাইভেট টিউশন থেকে সরিয়ে দেওয়ায় ক্ষোভ ছিল– এটা সে স্বীকার করেছে।
সিলেট পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, মুনতাহা নিখোঁজের ঘটনায় শনিবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিবেশী মার্জিয়াকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। মেয়েকে আটকের পর মার্জিয়ার মা মনে করেছিল, পুলিশ সবকিছু জেনে গেছে। এ জন্য রাতেই ডোবায় পুঁতে রাখা মুনতাহার লাশ তুলে পুকুরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রতিবেশীরা বিষয়টি বুঝতে পেরে পুকুরে লাশ ফেলে দেওয়ার আগেই তাকে আটক করেন। এ সময় শিশুটিকে নিজের কোল থেকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল আলিফজান। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার ও আলিফজানকে আটক করে।
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় আটক আলিফজান ও মার্জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে তারা বলেছে, মুনতাহার বাবার সঙ্গে তাদের বিরোধ আছে। তবে কী নিয়ে বিরোধ, তা জানা যায়নি। মুনতাহার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
শিশুটির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় শত শত নারী-পুরুষের ভিড়। স্বজন ও প্রতিবেশীরা নিহত শিশুটির পরিবারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। স্থানীয়দের তথ্যমতে, উপজেলার ছোটফৌদ গ্রাম থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে ভাড়ারীফৌদ গ্রামে আশ্রয় নেয় আলিফজান। এক শতকের কম জায়গার মধ্যে কোনোমতে স্থানীয়দের সহায়তায় সংসার চালাত সে। মাঝেমধ্যে ভিক্ষাও করত। মার্জিয়া চার বছর আগে এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। মাস ছয়েক আগে তার বিয়েবিচ্ছেদ হয়। দেড় বছর ধরে পাশের ঘরের বাসিন্দা মুনতাহাকে প্রাইভেট পড়াত সে। স্থানীয় মাদ্রাসায় নার্সারিতে পড়ত মুনতাহা। সাত ভাই-বোনের মধ্যে সে পঞ্চম। তার দুই ভাই প্রবাসী। মুনতাহার বাবা আগে সৌদিপ্রবাসী ছিলেন। কয়েক বছর আগে দেশে ফিরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান।
শিশুটির চাচা কয়ছর আহমেদ বলেন, কারও সঙ্গে আমার ভাইয়ের বিরোধ নেই। তবে মার্জিয়ার কাছে প্রাইভেট পড়াতে না দেওয়ার ক্ষোভ থেকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। গৃহশিক্ষিকা মার্জিয়াসহ এ হত্যায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি চাই।
এদিকে শিশুটির লাশ ময়নাতদন্ত শেষে বাদ আসর গ্রামের মসজিদের মাঠে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। জানাজায় শত শত লোক অংশ নেন।
কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আউয়াল বলেন, নিজ বাড়ির পুকুরে মুনতাহার নিথর দেহের সন্ধান পাওয়া যায়। তার গলায় রশি পেঁচানো ছিল। শরীরে ক্ষতচিহ্ন ছিল। লাশ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে।
গত ৩ নভেম্বর সকালে বাবার সঙ্গে স্থানীয় একটি ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফিরে প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিল মুনতাহা। কিন্তু বিকেল হলেও বাড়িতে না ফেরায় খোঁজ নিতে গিয়ে তার আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। শিশুটি নিখোঁজের পর থেকে পরিবার দাবি করে আসছিল, পরিকল্পিতভাবে তাকে ‘অপহরণ’ করা হয়েছে।
মুনতাহার সন্ধান এবং ‘অপহরণকারীকে’ ধরিয়ে দিতে পারলে ১ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন কয়েকজন প্রবাসী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তারা এ ঘোষণা দেন। এ ছাড়া ফারমিস আক্তার নামে সিলেটের এক নারী সমাজকর্মী মুনতাহার সন্ধানদাতার জন্য একটি স্বর্ণের চেন পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। অনেকে শিশুটির হাস্যোজ্জ্বল ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘এমন নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করার মতো পাষণ্ডও আছে?’ প্রবাসে থাকা সিলেটের সংস্কৃতিকর্মী আবু বকর আল আমিন লিখেছেন, ‘মানুষ পরিচয়টা এমন মুহূর্তে বড় লজ্জার হয়ে যায়। ক্ষমা করিস রে মা মুনতাহা।’ মুনতাহা লিখে হ্যাশট্যাগ দিয়ে আরেকজন লিখেন–‘আমাকে খুঁজতেছে সারা বাংলাদেশ। অথচ আমি বাড়ির পাশেই ছিলাম।’