মুন্সীগঞ্জে ইউরোপ স্টাইলে তৈরি কাঠের বাড়িতে থাকছে এসি
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি;
ইউরোপের আধুনিক সব বাড়ির আদলে টিন ও কাঠ দিয়ে নান্দনিক বাড়ি তৈরি হচ্ছে মুন্সীগঞ্জে। আর এসব কাঠের ঘরে থাকছে এসি বসানোর ব্যবস্থা। মূলত কাঠ ও টিনের তৈরি ঘর হলেও ঘরের দরজা-জানালায় ব্যবহার করা হচ্ছে থাই গ্লাস। যার ফলে পাকা ভবনের মতো কাঠ ও টিনের তৈরি ঘরেও এসি ব্যবহার করা যাচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার বড় নওপাড়া ও কলাবাগান এলাকায় তৈরি হচ্ছে নান্দনিক টিন ও কাঠের বাড়ি। এক সময় এখানে এক থেকে তিনতলা পর্যন্ত কাঠ ও টিন দিয়ে বাড়ি তৈরি হতো। আর চালে ব্যবহার করা হতো সাদা টিন। এখন এ বাড়িগুলোতে সাদা টিনের পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন রংয়ের আধুনিক টালী টিন যা বাড়ির সৌন্দর্যকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। তবে বর্তমানে এ বাড়িগুলো আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এর বিদেশি বাড়ির আদলে করা নকশার জন্য।
এ সমস্ত ঘরের বৈশিষ্ট্য হলে অন্যান্য কাঠের বা টিনের তৈরি ঘরের বেড়ায় টিন ব্যবহার করা হলেও এ সমস্ত ঘরের বেড়ায় এবং চালের নিচেও ব্যবহার করা হয় শুধু কাঠ। তাছাড়া বাড়ির চালে রঙিন টালী টিন দিয়ে এর নিচে কাঠ দিয়ে দেওয়া হয়। মূলত পুরো বাড়ি কাঠ দিয়ে ঘেরা থাকে এবং কাঠের জোড়ার মধ্যে পুডিং দিয়ে ঢেকে বাহারি রং করা হয়। দরজা-জানলায় থাই গ্লাস ব্যবহার করায় অনায়াসে এ সমস্ত ঘরে এসি ব্যবহার করা যায়।লৌহজং উপজেলার এ সমস্ত আধুনিক বাড়ির দৃশ্যধারণে প্রতিদিনই ইউটিউবাররা ভিড় করেন। ফলে পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাহারি নান্দনিক বাড়ির খবর। যা দেখে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ছুটে আসেন এখানে রেডিমেড বাড়ি কেনার জন্য। সব ধরনের নান্দনিক বাড়ি মিলছে এই এলাকায়। বাড়ির সঙ্গে মিলছে ঘরে বসানো এসিও। বড় নওপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একাধিক কর্টেজ ঘরের সঙ্গে এসি বসানো রয়েছে।
প্রায় ৫০ বছর ধরে মুন্সীগঞ্জের কমপক্ষে দেড় শতাধিক স্থানে গড়ে উঠেছে এই বাড়ি তৈরির কারখানা। এসব স্থানে আগে থেকেই টিন ও কাঠ দিয়ে তৈরি করে রাখা হয়। বাড়িগুলো এক থেকে তিন তলা পর্যন্ত হয়ে থাকে। বর্তমানে এ সমস্ত বাড়ির পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে কর্টেজ বাড়ি। যেগুলো দূর-দূরান্ত থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এসে কিনে নিয়ে যায়। বর্তমানে ঘর তৈরিতে ভিন্নতা নিয়ে এসেছে টালী টিন।
একদিকে এ বাড়ির কর্টেজ টাইপের ঘর গুলোতে যেমন এসি বসিয়ে পাকা ভবনের মতোই ঠান্ডা করা যাচ্ছে, অন্যদিকে কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি ঘরেগুলোতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস অনায়াসে প্রবেশ করেতে পারে। একটি পুরো বাড়ি অনায়াসে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যায়। টাকার প্রয়োজনে বিক্রিও করে দেওয়া যায়। ফলে এসব বাড়ির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে সিলেট, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, টেকনাফ থেকে বিভিন্ন রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা ছুটে আসছেন এ বাড়ি কিনতে।
এছাড়া মুন্সীগঞ্জের মানুষের পাশাপাশি, ঢাকা, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, চাদঁপুর, গাজীপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম জেলাসহ বাংলাদেশের প্রায় সব স্থান থেকে ক্রেতারা এসব বাড়ি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আগে এ সব বাড়ি তৈরিতে বার্মার লোহাকাঠ, শালকাঠ ও টিনের ব্যবহার বেশি ছিল। কিন্তু এখন বর্মার লোহাকাঠ ও শালকাঠের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবহার হচ্ছে নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ, সেগুনকাঠ। এছাড়া টিন দিয়ে অধিকাংশ বাড়ি নির্মাণ করা হয়। কর্টেজ টাইপের ঘরগুলোর বেড়ায় টিনের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে মেহগনি ও কেরাসিনকাঠ। এ কাঠগুলো সাধারণত নরম ও স্থায়ী হওয়ায় কর্টেজ ঘরের বেড়া ও চালের নিচে ব্যবহার করা হয়। এ ঘরের আড়ায় ব্যবহার করা হয় নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ। যা অনেক শক্ত ও মজবুত, স্থায়ীত্ব ১০০ বছর। এছাড়া দেশীয় কিছু কাঠ ব্যবহার হয়ে থাকে এগুলো তৈরিতে। তবে দেশীয় কাঠ দিয়ে তৈরি ঘরের মূল্য বিদেশে কাঠ দিয়ে তৈরি ঘরের মূল্যের অর্ধেক।
লোহাকাঠ দিয়ে নির্মিত বাড়িগুলো সাধারণত ৬০ বছর থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। একেকটি টিন ও কাঠ দিয়ে নির্মিত বাড়ি ১ থেকে ৩ তলা পর্যন্ত হয়ে থাকে। হাটে ২-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের বাড়ি বিক্রি হয়। তবে অনেকেই কাঠমিস্ত্রি এনে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়েও ২-৩ তলা প্রাসাদের মতো টিন ও কাঠ দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করেন। নান্দনিক ডিজাইনের কারণে মুন্সীগঞ্জের সবকটি উপজেলায় এ ধরনের বাড়ির প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জের প্রবাসীদের প্রথম পছন্দ বাহারি ডিজাইনের টিনের বাড়ি। প্রবাসীরা জীবনযাপনে বৈচিত্র্য আনতে এ বাহারি টিনের তৈরি বাড়ি কিনে থাকেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মুন্সীগঞ্জ সদর, টঙ্গীবাড়ী, লৌহজং, সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলায় গড়ে উঠেছে এসব বাড়ি বিক্রির হাট। বাড়ি বানিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে জমির ওপর সাজিয়ে রাখেন বিক্রেতারা। ক্রেতারা তাদের পছন্দের বাড়িটি দেখে পছন্দ করে কিনে নিয়ে যান।
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার বড় নওপাড়া ও কলাপাড়া এবং সদর উপজেলার বজ্রযোগীনি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে সবচেয়ে বেশি বাড়ি তৈরির কারখানা রয়েছ। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ চুরাইন গ্রাম।
এছাড়া সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়ন ও মোল্লাকান্দি ইউনিয়নেও রয়েছে একাধিক বাড়ি তৈরির কারখানা। টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বেতকা, বালিগাওঁ, কুন্ডের বাজার, দিঘিরপাড়, বাড়ৈইপাড়া, কালিবাড়ি, কামারখাড়া এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি বিক্রির হাট রয়েছে। শ্রীনগর উপজেলার শ্রীনগর ও দোহার সাড়কের বালাশুর বটতলা ও কামারগাঁও এলাকার রাস্তার পাশে খোলাস্থানে ঘর তুলে রাখেন বাড়ি ব্যবসায়ীরা। এছাড়া একই উপজেলার ভাগ্যকূল এলাকায়ও রয়েছে বাড়ি তৈরির কারখানা। সিরাজদিখান উপজেলার বালুচর, ইছাপুড়া লৌহজং উপজেলার নওপাড়া, মালিলংক, হাট বুগদিয়া, বড় নওপাড়া এলাকায়ও বাড়ি বিক্রির হাট রয়েছে।
বাড়ি নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ দিয়ে বেশিরভাগ বাড়ি তৈরি করা হয়। এছাড়া সেগুন, শাল, বাচালু ও ওকান কাঠের বাড়ির চাহিদাও রয়েছে। একটি কর্টেজ টাইপের ঘর তৈরি করতে ৪/৫ জনের আকারভেদে ১৫ দিন থেকে দেড় মাস পর্যন্ত সময় লাগে। এ সমস্ত কর্টেজ টাইপের বাড়ির দাম ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। কর্টেজ টাইপের বাড়ি ছাড়া একটি এক তলা ঘর নির্মাণ করতে ৫-৭ জন শ্রমিকের ৮-১০ দিন সময় লাগে। ঘরগুলো বিক্রি হয় ২ লাখ টাকা থেকে ৮ লাখ টাকায়। এদিকে ২য় ও ৩তলা বিশিষ্ট ঘরগুলো তৈরি করতে ৫-৭ জন মিস্ত্রির ২০-২২ দিন সময় লেগে যায়। এ সমস্ত বাড়ি সাধারণত ৭ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। এর চেয়ে বেশি দামেও বাড়ি পাওয়া যায়। তবে সেগুলো অর্ডার করার পর বানিয়ে দেওয়া হয়।
টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বালিগাওঁ বাজার দিঘিরপাড় বাজার, মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মুন্সীগরহাট, কাটাখালী, মীরকাদিম বাজারে, লৌহজং উপজেলার ঘোড়দৌর এলাকায় রয়েছে এ সমস্ত বাড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ কাঠের বাজার। এছাড়া এখানকার বাড়ি ব্যবসায়ীরা অনেকে চট্টগ্রামে বন্দরের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গাছ কিনে নিয়ে আসেন। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ডিজাইন করা টিন কিনতে পাওয়া যায়।
এসব নান্দনিক বাড়ি নির্মাণে গোপালগঞ্জের শ্রমিকদের আলাদা চাহিদা রয়েছে মুন্সীগঞ্জে। এ জেলায় গোপালগঞ্জ জেলার এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক ঘর নির্মাণকাজে জড়িত বলে কাঠমিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
কাঠমিস্ত্রি বিজয় বলেন, আমি পাঁচ বছর ধরে এ কাজ শিখেছি, এখন কাজ করি। আমরা মূলত কন্ট্রাক্টরের কাজ করি। কন্ট্রাক্টর আমাকে প্রতিদিন ৫৫০ টাকা দেয়। অনেককে ৭০০-৮০০ টাকাও দেয়। যারা বেশি ভালো কাজ পারে তারা বেশি টাকা পায়।
লৌহজং কলাবাগান এলাকার বাড়ি তৈরির কারিগর কামরুল বলেন, আমি একদিন কাজ করলে আমাকে ৭০০ টাকা দেওয়া হয়। আমি দুই বছর যাবৎ ঘরের কাজ করছি। তবে সিনিয়র মিস্ত্রিরা প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পায়।
ঘর তৈরির মহাজন মালেক সরদার বলেন, কর্টেজ ঘরগুলো মূলত আমরা ইউরোপে তৈরি বিভিন্ন ঘরের ক্যাটালগ দেখে তৈরি করি। এই বাড়িগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলোতে থাই গ্লাস ব্যবহার করা হয়। যার কারণে বাইরের পানি এই বাড়িতে ঢোকার কোনো সম্ভাবনা নেই। এগুলোর দরজা-জানালা আটকে দিলে বাতাস বাইরে যেতে পারে না। তাই সহজেই এসি ব্যবহার করা যায়।
কাঠমিস্ত্রি রাজু হোসাইন বলেন, কর্টেজ ঘরের বেড়ায় মেহগনি ও কেরাসিন কাঠ ব্যবহার করা হয়। মেহগনি ও কেরাসিন কাঠ একটু নরম হওয়ায় এ কাঠ দিয়ে সহজেই ডিজাইন করা যায়। কর্টেজ টাইপের একটি ঘর তৈরি করতে আমাদের পাঁচ থেকে সাতজন মিস্ত্রির এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। এই ঘরগুলো তৈরি করতে সাত থেকে আট লাখ টাকা খরচ হয়।
ঘর ব্যবসায়ী জসিম বেপারী বলেন, এই ঘরগুলো মূলত ইউরোপীয় বাড়ির আদতে তৈরি করা হয়। তাই এর চাহিদা বেশি। রির্সোট মালিকরা বিশেষ করে সিলেট টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে লোকজন আমাদের এখানে ঘর নিতে আসে। এই নাইজেরিয়ান লোহা কাঠের দাম অনেক বেশি। এক কিউব তিন হাজার টাকা। কাঠগুলো খুব শক্ত হওয়ায় এগুলোর ১০০ বছরে স্থায়িত্ব আছে। মেহেগুনি কাঠেরগুলো ৪০ থেকে ৫০ বছর স্থায়ী। আমরা এগুলোকে ভালো করে রং করে দেই। যাতে ঘুন পোকায় না ধরে। শুধু লৌহজং কাঠপট্টি এলাকায় ৩০ জনের মতো ঘর ব্যবসায়ী রয়েছেন। বিভিন্ন ইউটিউব এবং মিডিয়ায় প্রচারের কারণে দিন দিন আমাদের ঘর বিক্রি বাড়ছে। বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এ বাড়ি কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
মেসার্স আবিদ টিম্বার ট্রেডার্সের মালিক বড় নওপাড়া এলাকার ঘর ব্যবসায়ী ইমরান হোসেন বলেন, আমার বাবা আগে ঘর ব্যবসা করত। আমি উত্তরাধিকার সূত্রে এখন এই ব্যবসা করি। গত কয়েক বছর যাবৎ যেভাবে গরমের তীব্রতা বাড়তেছে তা দেখে চিন্তা ভাবনা করে এই ধরনের কটেজ ঘর তৈরি করছি। পুরোটাতেই কাঠ ব্যবহার করা হয়। চালের নিচেও কাঠ দেওয়া হয়। অন্যান্য কাঠের বাড়িতে যেমন টিনের বেড়া হয় এগুলোর বেড়া কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা হয়। তারপর বাহারি রং করা হয়। এ বাড়ি ঘরে আমরা এসি ব্যবহার করছি। আপনারা যে কেউ যেকোনো সাইজের বাড়ি নিতে চাইলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।