যশোর প্রতিনিধি:
ফুলের রাজ্য হিসেবে গত কয়েক দশকে দেশ-বিদেশে পরিচিতি পেয়েছে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী এলাকা। বছরজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে এখানে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, টিউলিপ, জারবেরা, গাঁদাসহ অন্তত ২০ রকমের ফুল। ভ্যালেনটাইনস ডে, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, মহান বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস, নববর্ষসহ বিশেষ দিবসগুলোর পাশাপাশি গদখালীর ফুল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় সব জেলাতেই যায়।
গদখালী এলাকার পানিসারা গ্রামের প্রশিক্ষিত তিনজন নারী ফেলনা বা পরিত্যক্ত ফুলের পাপড়ি থেকে সুগন্ধি সাবান, সুগন্ধি নারিকেল তেল, রূপচর্চার ফেসপ্যাক, ব্যাথানাশক তেল, আগরবাতি, কাপড় ডাইং, চিরুনি, গলার লকেট, কানের দুল, চুড়ি, আংটি, চুলের কাঁটাসহ ৩০ রকমের পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আত্ম কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক নারী।
যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, যশোর জেলায় দেড়হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়। যার মধ্যে শুধু গদখালীতেই চাষ হয় একহাজার দুইশ’ হেক্টর জমিতে। সারা বছরে গদখালী বাজারে চারশ থেকে পাঁচশ কোটি টাকার ফুল কেনা-বেচা হয়। কাঁচা ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় এই ফুলের একটি অংশ ব্যবহার অনুপযোগী ও নষ্ট হয়ে যায়। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত চাহিদার দিক দিয়ে ফুলের যখন ভরা মৌসুম, তখন চাষিরা একসাথে অনেক বেশি ফুল উৎপাদন করেন। এ সময় দামও কমে যায়। তখন চাষিরা অনেক তাদের কষ্টে উৎপাদিত অনেক ফুল গরু-ছাগলের খাদ্য হিসাবে দেন অথবা ফেলে দেন। করোনার মতো মহামারি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়েও প্রচুর ফুল নষ্ট হয়। সবমিলিয়ে গড়ে বছরে এক থেকে দেড়শ কোটি টাকার ফুল নষ্ট হতো।
তিনি জানান, এসব ক্ষতি কমাতে ফুল থেকে বিকল্প পণ্য তৈরির লক্ষ্যে সমিতির পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছিল। পরে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্পের মাধ্যমে গদখালী এলাকার পানিসারা গ্রামের তিনজন নারীকে প্রশিক্ষণ নিতে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের ড. ওয়াইএসআর হর্টিকালচার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়। ওই তিন নারী হলেন, পানিসারা গ্রামের রাবেয়া খাতুন, একই গ্রামের গৃহবধূ নাসরিন নাহার আশা এবং হাড়িয়া গ্রামের সাজেদা বেগম। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে তিন নারী ফিরে স্থানীয় আরও ২৭ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এখন ওই এলাকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীর সংখ্যা ৬০ জন।
ভারতের ড. ওয়াইএসআর হর্টিকালচার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা রাবেয়া খাতুন জানান, আপাতত গোলাপ, গাঁদা ও রজনীগন্ধা ফুল থেকে তারা ২৫ থেকে ৩০ রকমের পণ্য তৈরি করছেন। গোলাপের শুকনো পাপড়ি গুঁড়া থেকে তৈরি করছেন সুগন্ধি সাবান, মেয়েদের রূপচর্চার ফেসপ্যাকসহ বিভিন্ন প্রসাধনী ও আগরবাতি। গোলাপ, গাঁদার পাপড়ি জ্বাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রাকৃতিক রং, যা দিয়ে কাপড়ে নকশা করা হচ্ছে। রজনীগন্ধা ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি হচ্ছে সুগন্ধি তেল ও গোলাপজল। তাদের তৈরি এসব পণ্য অর্গানিক। এ ছাড়া গোলাপের শুকনো পাপড়ি দিয়ে দৃষ্টিনন্দন ওয়ালম্যাট, চুড়ি, কানের দুল, চাবির রিং, ফটোফ্রেম ও কলম তৈরি করা হচ্ছে।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা সাজেদা বেগম জানান, ফুল থেকে উৎপাদিত এসব পণ্য তারা শহরের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন। প্রতিদিন শত শত মানুষ গদখালীর ফুল দেখতে আসেন। তারাও এসব পণ্য কেনেন। তবে সনাতন পদ্ধতিতে কাজ করায় চাহিদার তুলনায় তারা খুব বেশি পণ্য উৎপাদন করতে পারছেন না। কারখানা তৈরি করে এসব কাজ করতে পারলে আরও বড় পরিসরে এসব অর্গানিক পণ্য বাজারজাত করা সম্ভব।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা নাসরিন নাহার আশা জানান, সংসারের সব কাজ সেরে তারা এসব পণ্য উৎপাদন করে নিজেরা যেমন ব্যবহার করছেন, বিভিন্নভাবে সেগুলো বিক্রি করে সংসারের বাড়তি আয়ের ক্ষেত্রেও ভূমিকাও রাখছেন।
যশোর ফুল উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, সারা পৃথিবীতে এখন অর্গানিক পণ্যেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কারখানা স্থাপনের জন্য এসব নারী উদ্যোক্তাদের যদি সরকার সহযোগিতা করে, তাহলে এসব পণ্য করে বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব।