যান্ত্রিক ত্রুটি ও রক্ষণাবেক্ষণের গুরুত্ব

প্রকাশিত: ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৬, ২০২৫

নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

প্রযুক্তির কারণে মানুষের জীবনযাত্রা অনেক সহজ হইয়াছে। আবার প্রযুক্তির কারণেই মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িতেছে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। প্রযুক্তির যুগান্তকারী আবিষ্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হইল অত্যাধুনিক লিফট। লিফট ব্যবহার মানুষের সময় কমাইয়া প্রশান্তি দিয়াছে। অফিস-আদালত হইতে শুরু করিয়া বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক ভবন, শপিং মল এমনকি আজকাল স্কুল-কলেজগুলিতেও লিফট ব্যবহৃত হইতেছে অহরহ। কিন্তু অন্যান্য যন্ত্রপাতির ন্যায় লিফটের রক্ষণাবেক্ষণে আমরা কতটা সচেতন? এই ক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব আছে বলিয়াই মাঝেমধ্যে আমাদের দেশে ভয়াবহ লিফট দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়; যেমন-গত রবিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি লোহার রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে লিফটের তার ছিঁড়িয়া নিচে পড়িয়া মৃত্যু হইয়াছে দুই শ্রমিকের। ইত্তেফাকের খবরে প্রকাশ, সুলতানা মঞ্জিল এলাকায় জিপিএইচ ইস্পাত কারখানার মালামাল তুলিবার সময় লিফটের তার ছিঁড়িয়া গেলে ঐ দুই শ্রমিক অকস্মাৎ নিচে পড়িয়া যান। পরে উদ্ধার করিয়া হাসপাতালে নেওয়ার পর তাহাদের মৃত্যু হয়।

দেশে লিফট দুর্ঘটনার খবর ইহাই প্রথম নহে। বিভিন্ন অফিস-আদালতে ও আবাসিক এলাকায় প্রায়শ এমন দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটিতেছে। লিফটে আটকা পড়িয়া শিশুর মৃত্যুর ঘটনা যেমন আছে, তেমনি আতঙ্কে অনেকের হার্ট অ্যাটাকের খবরও আমরা পাই। আবার লিফটের সেন্সর ঠিকমতো কাজ না করায় লিফটের দরজা খুলিলেও লিফট না আসায় অনেকে লিফটের নিচে পড়িয়া মারা যান। তবে সাধারণত লিফট ছিঁড়িয়া যাইবার ঘটনা খুব বেশি ঘটে না, একেবারেই যে ঘটে না, তাহা নহে। আসলে পৃথিবীতে কেহই দুর্ঘটনার হাত হইতে সম্পূর্ণ নিরাপদ-এই কথা বলিবার অবকাশ নাই। তবে একটু সতর্ক হইলে এবং কর্তৃপক্ষ দায়িত্বে অবহেলা না করিলে অনেকটাই নিরাপদ থাকা যায়।

লিফট দুর্ঘটনা যখন ঘটে, তখন সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারিলে জীবন বাঁচিয়া যাইতে পারে কিংবা কম আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিবার সময় আমাদের মনে রাখিতে হইবে, কিছুতেই লাফ দেওয়া যাইবে না। আবার লাফালাফি করা বা সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া থাকা যাইবে না। মাস্যাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টারের গবেষক ইলিয়ট এইচ ফ্রাংকের মতে, লিফট যখন পড়িয়া যাইতে থাকিবে, তখন যত দ্রুত সম্ভব চিত হইয়া দুই হাত ও পা ছড়াইয়া লিফটের মেঝেতে শুইয়া পড়া একমাত্র নিরাপদ কৌশল। ইহাতে শরীরের অপেক্ষাকৃত মজবুত অংশগুলোতে শক্তি ছড়াইয়া পড়িবে। নিচে পড়ার আঘাত শরীরের সকল অংশে সমানভাবে ছড়াইয়া যাইবে বলিয়া ভারসাম্য রক্ষা করিয়া শরীরের নির্দিষ্ট কোনো অংশে কম আঘাত লাগিতে পারে। লিফটে বেশি মানুষ থাকিলে এই পরিস্থিতিতে সবচাইতে ভালো পন্থা হইল, লিফটের মেঝেতে বসিয়া পড়া। দাঁড়াইয়া থাকিলে অস্থিতে যে পরিমাণ চাপ পড়িত, তাহার তুলনায় অস্থিতে কম চাপ পড়িবে এই পজিশনে। আর এই ধরনের দুর্ঘটনা এড়াইতে নিয়মিত লিফট সার্ভিসিংয়ের কোনো বিকল্প নাই। ভবন মালিক, রক্ষণাবেক্ষণকর্মী এবং ব্যবহারকারী প্রত্যেকের উচিত, এই ব্যাপারে সচেতন থাকা।

লিফটের তার, পুলি ও মোটরগুলির মতো উপাদানগুলি উল্লেখযোগ্য চাপের মধ্য দিয়া যায়, যাহা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করিলে দুর্ঘটনার কারণ হইতে পারে। আরেকটি প্রচলিত সমস্যা হইল বৈদ্যুতিক সমস্যা, যাহা ত্রুটিপূর্ণ ওয়‍্যারিং, কন্ট্রোল সিস্টেমের ত্রুটি বা পাওয়ার সাপ্লাই বাধার কারণে হইতে পারে। আবার তাপমাত্রার ওঠানামা, আর্দ্রতা এবং ধুলাবালি লিফট পরিচালনায় বিরূপ প্রভাব ফেলিতে পারে, যাহার ফলে ক্ষয় বা উপাদানের অবক্ষয় ঘটে। মূল উপাদান; যেমন-উত্তোলন দড়ি, শেভস এবং বিয়ারিংগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী চাপ সহ্য করে, যাহা নিয়মিতভাবে পরিদর্শন এবং প্রতিস্থাপিত না হইলে ফ্রেয়িং, মিসলাইনমেন্ট বা সম্পূর্ণ ভাঙনের কারণ হইতে পারে। তদুপরি, লিফটের ব্রেক সিস্টেমের সমস্যা হইতে পারে। চলমান অংশগুলির নিয়মিত তৈলাক্তকরণ এবং জীর্ণ উপাদানগুলির সময়মতো প্রতিস্থাপন সর্বোত্তম যান্ত্রিক অপারেশন বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। এই ক্ষেত্রে নিরাপত্তা কোড যথারীতি মানিয়া চলা প্রয়োজন। মোদ্দা কথা, শুধু লিফট নহে, যেই কোনো যন্ত্রপাতির ব্যবহারে টেস্টিং বা পরীক্ষানিরীক্ষা ও সার্ভিসিং তথা রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি আমাদের গুরুত্বারোপ করিতে হইবে।