সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি:
তখনো সূর্য ওঠেনি। হাতে টর্চ লাইট ধরে ভাঙরি কুড়াতে দেখা যায় তিন নারীকে। শরীরে পাতলা চাদর জড়ানো। হার কাঁপানো শীতের তীব্রতা যেন হার মেনেছে পেটের ক্ষুধার কাছে। মূলত লেদ মেশিনে কাজের লোহা জাতীয় পণ্য কুড়াতে এসেছেন। কোনো প্রতিকূলতার কষ্ট নেই, যেন জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকাই মুখ্য।
ময়না রানী দাশ, সাগরি রানী দাশ ও শেফালি রানী দাশ নামের তিন নারীর বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলায়। বিনসাড়া গ্রামের পূর্ব পাড়ায় তাদের স্থায়ী বসবাস। ডলি রানী দাশ, রিনা রানী দাশ, কাজলি রানী দাশসহ আরও বেশ কয়েকজন রয়েছেন এ গ্রামে। যাদের সংসার টেনেটুনে চলে ভাঙরি কুড়িয়ে।
ময়না রানী দাশ, সাগরি রানী দাশ ও শেফালি রানী দাশ দৈনিক ইত্তেফাককে বলেন, সহায় সম্বল নেই তাদের। বিশেষ করে নিজের ও পরিবারের খাওয়ার যোগাতে কখনো অন্যের দুয়ারে ভিক্ষাও করতে হয়।
ময়না রানী দাশ (৫৬) বলেন, তার স্বামী কুটিল দাশ মারা গেছেন ২২ বছর হতে চলেছে। একমাত্র ছেলেও কাজের সন্ধানে ঢাকা যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। পরিবারে ছেলের বউ ও তার তিন সন্তান রয়েছে। কিন্তু উপার্জনের কেউ নেই।
চিনি দাশের স্ত্রী সাগরি রানী দাশ বলেন, তার স্বামীর হার্টের অসুখ। মাসে একদিনও কাজে যেতে পারেন না। ওষুধ কেনারও টাকা নেই। দিনকে দিন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ছেন। এক ছেলে বিয়ে করে ঢাকায় থাকেন। মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে-মেয়ে কেউ তাদের খোঁজ রাখেন না।
শেফালী রানী দাস বলেন, তার স্বামী নগেন দাশ মারা গেছেন তিন বছর হচ্ছে। ছোট ছেলে বউ নিয়ে ঢাকায় থাকেন। বড় ছেলে গ্রামেই থাকেন, কিন্তু আলাদা সংসার। মেয়েরও বিয়ে দিয়েছেন। কেউ মাকে খেতে দেয়না, মায়ের খোঁজ-খবরও নেয়না।
এদিকে স্থানীয় বে-সরকারী উন্নয়ন সংস্থা পরিবর্তনের উপ-পরিচালক ও নারী নেত্রী রোখসানা খাতুন বলেন, আমাদের সমাজে ময়না রানী দাশের মত আরও অসংখ্য ময়না রয়েছেন। নিজেরা খেয়ে-না খেয়ে সীমাহীন কষ্টের মধ্যে সন্তানের খাবার যোগান, সন্তান বড় করে তোলেন। সেই সন্তান বাবা-মার খোঁজ রাখেন না। তাদের নিজেদের খাবার জোটে, অথচ অসহায় মা-বাবার খাবার জোটাতে পারে না। বেঁচে জন্য ময়নাদের বিরামহীন ছুটে চলতে হয়।
তিনি আরও বলেন, মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছি আমরা। গ্রামীণ উঠান বৈঠকে মা-বাবা ও সন্তান একসঙ্গে করে মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সর্ম্পকে সচেতনতামূলক আলোচনা করা হয়।
ময়না রানী দাশ, সাগরী রানী ও শেফালী রানী আরও বলেন, বিনসাড়া হাটে দুইটি লেদ মেশিন ও দুটি ভ্যান-সাইকেল মেরামতের দোকান রয়েছে। দোকানের আশপাশে পড়ে থাকা লোহা কুড়াতে ভোর রাতে উঠে আসি। কাগজ, প্লাষ্টিকের বতল, টিনের টুকরাসহ অনেক কিছুই পাই। যা ভাঙরির দোকানে বেচা যায়। আগে ধানের হাট ঝাড়ু দিতেন, সামান্য ধান পেতেন। দুই বছর ধরে আরিফ নামে এক ব্যক্তি ঝাড়ু দিয়ে নেয়। কুড়ানো ভাঙরি সাত দিন পর বেচে ৩০ টাকা থেকে সর্বচ্চ ১৫০ টাকা পাওয়া যায়। সেই টাকায় বিনসাড়া হাটের দিন বাজার করেন।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা (অঃ দাঃ) মো. ইলিয়াস হাসান শেখ বলেন, বিধবাদের জন্য বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করা যাবে। বছরে একবার ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়, সেখান থেকে অসুস্থ ব্যক্তির চিকিত্সার জন্য কিছু সহায়তা করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা খাদিজা-নাছরিন বলেন, ভিডাব্লিউবি কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। সমাজসেবাতে যোগযোগ করতে পারেন।