যেভাবে পরিবার ফিরে পেল ছোট্ট ইয়ামিন

প্রকাশিত: ৬:৪৮ অপরাহ্ণ, মে ৯, ২০২৪

জেলা প্রতিনিধি,খুলনাঃ 

ছোট্ট ইয়ামিনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার লালপুর গ্রামে। জন্মের সময় তার মা মারা যান। বুঝতে শেখার পরই ইয়ামিন শুনে আসছে, মা বেড়াতে গেছে। এজন্য প্রায়ই মাকে খুঁজতে বের হতো।গত ১৯ মার্চ মাকে খুঁজতে ট্রেনে উঠে পড়ে ৭ বছরের ইয়ামিন। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী ওই ট্রেনের গন্তব্য ছিল কমলাপুর রেলস্টেশন। সেখান থেকে ভুল করে এবার সে উঠে পড়ে খুলনাগামী ট্রেনে।

খুলনায় পৌঁছানোর পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শিশুটি। স্থানীয়রা ইয়ামিনকে দেখে হরিণটানা থানা পুলিশকে বিষয়টি জানায়। ইয়ামিনের আশ্রয় হয় খুলনার শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সেখানে কেটে যায় দেড় মাস। এরপরের অংশটুকু বইয়ের গল্পের মতো।সমাজসেবা কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা উদ্যোগ নেন ঠিকানাহীন শিশুটিকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেবে। তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা। নানা প্রচেষ্টায় সফলও হয়েছেন তারা। গত ৮ মে রাতে দেড় মাস পর পরিবার ফিরে পেয়েছে শিশু ইয়ামিন।

গত ১৯ মার্চ ইয়ামিনকে খুঁজে পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা ও হরিণটানা থানা পুলিশের এসআই মাসুম বিল্লাহ জানান, ইয়ামিনের পরিবার খুঁজে বের করতে কমলাপুর রেলস্টেশনের আশপাশের থানাগুলোতে তথ্য পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো থানা থেকে ইয়ামিনের পরিবারের সন্ধান কেউ দিতে পারেনি। এভাবে দেড় মাস কেটে গেছে। পরে সমাজসেবা কর্মকর্তা উদ্যোগী হন ইয়ামিনের বাড়ি খুঁজে বের করতে। আমি ও থানার কনস্টেবল মো. সাহাবুদ্দিন পুলিশের পক্ষ থেকে ওই টিমে ছিলাম।

এই মহতী কাজের প্রধান উদ্যোক্তা বটিয়াঘাটা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সরদার আলী আহসান। তিনি জানালেন, ইয়ামিনকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া গল্পের পরের অংশ।পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকা অবস্থায় ইয়ামিন প্রায় বলতো রেলস্টেশনে নিয়ে গেলে সে বাড়ি খুঁজে বের করতে পারবে। তার কথায় আস্থা রেখে গত ৮ মে ভোরে সরদার আলী আহসানের নেতৃত্বে সমাজসেবার ৩ এবং পুলিশের দুইজন মিলে ৫ সদস্যের একটি দল ইয়ামিনকে নিয়ে কমলাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। অবশ্য এক মাস আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অনুমতি নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

সকাল ১০টায় কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছানোর পর দেখা যায়, ইয়ামিন সেখানকার কিছুই চেনে না। আশপাশের থানা এবং সমাজসেবা কার্যালয়ে যোগাযোগ করেও শিশু হারানোর তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রায় ৩/৪ ঘণ্টা ওই এলাকায় খোঁজাখুঁজি করে কমলাপুর রেলস্টেশনে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তারা। প্লাটফর্মে দাঁড়ানো একটি ট্রেন দেখে ইয়ামিন জানায়, এই ট্রেনে সে বাড়ি থেকে এসেছে। ওই ট্রেনে গেলে সে বাড়ি চিনতে পারবে।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ট্রেনটি নারায়ণগঞ্জের। ২টা ৪০ মিনিটে ট্রেন ছাড়বে। ইয়ামিনকে নিয়ে তারা ওই ট্রেনে ওঠেন। এরই মধ্যে এক ব্যক্তি ইয়ামিনকে চিনতে পারেন। ওই ব্যক্তি জানান, ইয়ামিনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার লালপুর গ্রামে। তার বাবার নাম সাইফুল ইসলাম। তখন ট্রেনে ফতুল্লা রেলস্টেশনে নেমে লালপুর গ্রামে যান। ইয়ামিনকে দেখে তার পরিবারের সদস্যরা ছুটে আসেন। মা হারা শিশুকে ফিরে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার বাবা। ইয়ামিনের স্বজন ও খেলার সাথীরাও আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে।

ইয়ামিনের বাবা সাইফুল ইসলাম বলেন, অনেক জায়গায় ওকে খুঁজেছি। কিন্তু খুঁজে পাইনি। আমার মা হারা ধনকে কাছে ফিরে পেয়েছি, তাতেই আমি খুশি।স্থানীয়রা জানান, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ইয়ামিনের বাবা সাইফুল ইসলাম আর বিয়ে করেননি। মা হারা ইয়ামিন বাবাসহ চাচা ফুফুদের সঙ্গে গ্রামে থাকে। ইয়ামিনের বাবা পরিবহন শ্রমিক হওয়ায় প্রায় বাইরে থাকে। এই ফাঁকে প্রায় মাকে খুঁজতে নিরুদ্দেশ হতো ইয়ামিন।

সমাজসেবা কর্মকর্তা সরদার আলী আহসান বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অন্যতম একটি কাজ হারিয়ে যাওয়া শিশুদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু নানা কারণে অনেকেই সেটা করে না। আমার ছোট একটি মেয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নেই, ইয়ামিনকে যেভাবে হোক বাড়ি পৌঁছে দেব। জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, খুলনার পুলিশ কমিশনার, বটিয়াঘাটার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, হরিণটানা থানার ওসি সবাই যার যার অবস্থান থেকে সহযোগিতা করেছেন।