রংপুর হাইটেক পার্ক ৬ মাস ধরে বন্ধ নির্মাণকাজ, নকশা থেকে বাদ ডরমিটরি-সিনেপ্লেক্স

প্রকাশিত: ৫:১২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ছয় মাস ধরে বন্ধ রয়েছে রংপুর হাইটেক পার্কের নির্মাণকাজ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লারসন অ্যান্ড ট্রব্য লিমিটেড (এলঅ্যান্ডটি) চলে যাওয়ায় প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কবে থেকে কাজ শুরু হবে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষও নিশ্চিত তথ্য দিতে পারছে না। এরই মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় কমাতে মূল নকশা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ডরমিটরি ও সিনেপ্লেক্স।

সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের খলিশাকুড়ি এলাকায় ১০ দশমিক ৭৭ একর জমিতে নির্মিত হচ্ছে এই হাইটেক পার্ক। যেখানে প্রতিদিন শত শত শ্রমিকের কর্মচাঞ্চল্যে জমজমাট থাকত, সেখানে এখন বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নির্মাণসামগ্রী, অলস পড়ে আছে ক্রেনসহ ভারী যন্ত্রপাতি। পুরো এলাকায় হাতেগোনা কয়েকজন নিরাপত্তা প্রহরী ছাড়া আর কেউ নেই।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১৭ সালে দেশের কয়েকটি জেলায় হাইটেক পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল জেলা পর্যায়ে ১২টি হাইটেক পার্ক প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৮৪৬ কোটি ৯ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এর মধ্যে সরকার অর্থায়ন করবে ৩০২ কোটি ৯ লাখ টাকা। বাকি টাকা আসবে ভারতীয় সরকারের ঋণ হিসাবে। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

নকশা অনুযায়ী হাইটেক পার্কে তিনটি ভবন নির্মাণ করার কথা রয়েছে। এগুলোর একটি স্টিল স্ট্রাকচারে তৈরি সাততলার মাল্টি ট্যালেন্ট (এমটিবি) ভবন। দুটি তিনতলার ক্যান্টিন ও সিনেপ্লেক্স এবং ডরমিটরি ভবন। নির্মাণকাজ ২০১৭ সালে শুরু হয়ে ২০২০ সালের মধ্যে শেষ করা কথা ছিল। তবে দুই বছর পিছিয়ে প্রকল্পটি উদ্বোধন করা হয় ২০২২ সালের ২৬ মে। চলতি বছরের জুলাইয়ে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ২৫ শতাংশ কাজ হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর থেকে সর্বশেষ কাজ হয়েছে ২ আগস্ট। নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন নিজ দেশে চলে যান। এমনকি ডরমিটরি এবং সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য রড, সিমেন্টসহ নির্মাণ উপকরণ জুনে আনা হলেও আগস্টের শেষদিকে আবার তা ফিরে নিয়ে যায় এম এন হুদা কনস্ট্রাকশনের লোকজন। এর পর থেকে হাইটেক পার্কের কাজে স্থবিরতা নেমে আসে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) একেএম ফজলুল হক বলেন, বন্ধ থাকা কাজ এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ব্যয় কমানোর জন্য যেসব কাজ সরাসরি সরকারি অর্থে নির্মাণের কথা সেগুলো বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই সংশোধিত প্রকল্পটিতে থাকছে না ডরমিটরি এবং সিনেপ্লেক্স যা আগের মূল নকশায় ছিল। তবে শুধু নির্মাণ হবে স্টিল স্ট্রাকচারে তৈরি সাততলার মাল্টি ট্যালেন্ট ভবন এবং আনুষঙ্গিক ইলেকট্রিক্যাল সাবস্টেশন, সীমানাপ্রাচীর, আন্ডার গ্রাউন্ড ট্যাংক, গেট ও গার্ড রুম এবং স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। প্রকল্পটিতে ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে ১৫০ কোটি টাকা।তিনি আরও বলেন, কাজের মেয়াদ যেহেতু শেষ হয়েছে, তাই প্রথম দফায় এক বছর বাড়ানো হয়েছে। তবে কাজের মেয়াদ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাড়বে। ভারতীয় ঠিকাদারের লোকজন ঢাকায় এসেছে এবং অল্প সময়ে তারা রংপুরে কাজে যোগদান করবেন। হাইটেক পার্কের সার্বিক কাজের অগ্রগতি হয়েছে ২৫ শতাংশ।

স্থানীয়রা জানান, গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনের পর থেকেই প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চলতে থাকে এবং ৫ আগস্টের পর একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে নিরাপত্তাকর্মীদের ছাড়া তেমন কাউকে আর দেখা যায় না।

এদিকে হঠাৎ করে হাইটেক পার্কের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শঙ্কিত উদ্যোক্তারা বলছেন, রংপুরে ভারী শিল্পকারখানা নেই, সেক্ষেত্রে আইটিনির্ভর হাইটেক পার্কটি গড়ে উঠলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি বিশেষায়িত পেশার দ্বার খুলবে। বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আত্মনির্ভর হতে চাওয়া তরুণ-তরুণীরা বেশি উপকৃত হবেন।

হাইটেক পার্ককে কেন্দ্র করে প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পায়ন, হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার শিল্পের উত্তরণ ও বিকাশে সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন আইটি বিশেষজ্ঞরা। তবে হাইটেক পার্ক নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা। তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বন্ধ থাকা এই প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহবুব  বলেন, দেশের তরুণ সমাজকে তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে নিতে এই প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। তা না হলে শিক্ষিত তরুণদের জ্ঞান কাজে লাগানো সম্ভব হবে না, বরং বেকারত্ব বাড়বে।

রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, আমরা কাজ শুরু করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। তারা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে। আশা করছি দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে এবং প্রকল্পের কাজ পুনরায় শুরু হবে।