সেলিনা আক্তার:
কারসাজি রোধে নজরদারি বাড়ানোসহ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি, এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের
প্রতি বছর রমজানে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, খেজুর ও পেঁয়াজের। দেখা যায়, প্রায় বছরই এই পণ্যগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি নিয়ে রমজানে বাজারে রীতিমতো অস্থিরতা দেখা দেয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন ক্রেতারা। এবারও সেই শঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে পবিত্র রমজান শুরু হবে। এ হিসেবে রমজান শুরু হতে আর মাত্র দেড় মাস বাকি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এখন বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দর নিম্নমুখী। এছাড়া রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পণ্য আমদানিতে বড় ধরনের শুল্ককর অব্যাহতি দিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। ফলে নিত্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। তাই আসন্ন রমজানে এসব নিত্যপণ্যের কোনো সংকট হবে না। তবে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, কোনো কোনো ব্যাংক পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যা করছে। ফলে তারা চাহিদামতো কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না। এতে আগামী রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে।
দেশে প্রতি বছর ভোজ্য তেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে আড়াই লাখ টন তেল দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি ২০ থেকে ২১ লাখ টন ভোজ্য তেল আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টন। ট্যারিফ কমিশন সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৫২৫ টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৮০ টন ও পাম তেল ৭ লাখ ১১ হাজার ৪৪৪ টন। তবে সয়াবিন ও পামঅয়েল আমদানির এই পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কম। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আরও ৪ লাখ ২১ হাজার ৯৬৬ টন তেল আমদানি পাইপলাইনে রয়েছে। রমজান শুরু হতে এখনো যে সময় বাকি আছে, তাতে এই তেল চলে আসবে।
আগামী রমজানে ভোজ্য তেলের বাজার কেমন হতে পারে- এ প্রশ্নে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, গত এক মাসের মধ্যে সয়াবিন, পামঅয়েলের দাম কিছুটা বেড়েছে। এখন পাইকারি বাজারেও ভোজ্য তেলের দর নিম্নমুখী। ফলে সরবরাহ সমস্যা না হলে আসন্ন রমজানে সয়াবিন, পামঅয়েলের দাম বাড়ার কারণ নেই।
রমজানে চাহিদার শীর্ষে থাকা পণ্যগুলোর একটি ছোলা। শুধু তাই নয়, সারা বছরে ছোলার চাহিদার বড় অংশ রমজানকে ঘিরেই। প্রতি বছর দেশে ছোলার চাহিদা ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজানেই ছোলার চাহিদা থাকে ১ লাখ টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৯৮০ টন ছোলা আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৭ হাজার ৪৪৬ টন ছোলা। এছাড়া চলতি বছর ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯১৯ টন ছোলা আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। পাইপলাইনে আছে আরও ১ লাখ ৫৪ হাজার ১৯১ টন ছোলা। ফলে ছোলা নিয়েও কোনো ধরনের সংকট হওয়ার আশঙ্কা নেই।
তবে রমজানের আরেক পণ্য চিনি নিয়ে কিছুটা শঙ্কার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রমজানে প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির আমদানিও হয়েছে গত বছরের তুলনায় কম। ট্যারিফ কমিশন সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ৬ লাখ ৬৪ হাজার ১৭৬ টন চিনি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে পরিশোধিত চিনি ১ লাখ ১ হাজার ১৭১ টন ও অপরিশোধিত চিনি ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৫ টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে মোট ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৮০ টন চিনি আমদানি করা হয়েছিল। এছাড়া চলতি অর্থবছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৪ টন চিনি আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। গত বছর একই সময়ে ৯ লাখ ১৬ হাজার ৪২৫ টন চিনি আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছিল।
রমজানে চিনির সরবরাহ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব ও দেশবন্ধু গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) মোমতাজুল ইসলাম বলেন, দেশের বেশ কয়েকটি বড় বড় শিল্পগ্রুপ এরই মধ্যে এলসি খুলতে না পেরে তাদের উৎপাদন কমিয়েছে। এমনকি কেউ কেউ কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি বলেন, অনেক ব্যাংক শতভাগ ক্যাশ মার্জিন দেওয়া সত্ত্বেও এলসি করতে অপারগতা প্রকাশ করছে। ফলে এই কারখানাগুলো কাঁচামালও আমদানি করতে পারছে না।
গত বছর আমদানি শুল্ক কমিয়ে দর বেঁধে দিয়েও রমজানে খেজুরের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এ বছরও খেজুর আমাদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ৫ হাজার ৮৮৩ টন খেজুর আমদানি করা হয়েছে। একই সময়ে খেজুর আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৮৬ হাজার ১০৯ টন। পাইপলাইনে আছে আরও ৭৫ হাজার ২৫৮ টন খেজুর। গত অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৯ হাজার ৬২৮ টন খেজুর আমদানি হয়েছিল। এদিকে এবার বিশ্ববাজারে খেজুরের দাম গত বছরের তুলনায় কম। তাই এবার দেশেও খেজুরের দাম কম থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
সারা বছর দেশে মসুর ডালের চাহিদার ৭ লাখ টনের মধ্যে ১ লাখ টনই লাগে রমজানে। আর মোট চাহিদার প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টন দেশে উৎপাদিত মসুর ডাল থেকে মেটানো হয়। বাকিটা আমদানি করা হয়। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৫৬১ টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ৯০ হাজার ৮৭ টন। এছাড়া চলতি বছর এখন পর্যন্ত ২ লাখ ২ হাজার ৯৭২ টন মসুর ডাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। ফলে এবার রমজানে চাহিদার চেয়ে বেশি মসুর ডালের সরবরাহ থাকবে। এছাড়া ভরা মৌসুম হওয়ায় রমজানে এবার পেঁয়াজের বাজারও স্থিতিশীল থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
এদিকে রমজানে যেন বাজার স্থিতিশীল থাকে সেজন্য সরকার এ সময় সারা দেশে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ৫৭ লাখ কার্ডধারীকে ভর্তুকি মূল্যে বিভিন্ন নিত্যপণ্য দেবে। এজন্য সরকার ১০ হাজার টন মসুর ডাল, ৫ কোটি ৫০ লাখ লিটার ভোজ্য তেল এবং ১৫ হাজার টন চিনি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ব্যয় হবে ১ হাজার ১৯৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সম্প্রতি সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে এসব পণ্য কেনার প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে।
রমজানে বাজার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এফ এম নাজির হোসেইন গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, গত ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর অনেক বড় আমদানিকারক গা ঢাকা দিয়েছে। এজন্য পণ্য আমদানিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা তা সরকারকে এখনই দেখতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে চাহিদামতো নিত্যপণ্যের আমদানি ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার অবশ্য আমদানি বাড়াতে ইতিমধ্যে শুল্ক কমানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ভোক্তারা সাধারণত এসব উদ্যোগের সুফল পায় না। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রতি বছরই কোনো না কোনো পণ্য নিয়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে ব্যবসায়ীরা ফায়দা তোলার চেষ্টা করে। এটা যেন না পারে এজন্য কারসাজি রোধে সরকারকে বাজারে নজরদারি বাড়ানোসহ কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।