
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
মিয়ানমারের রাখাইনের সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। আর মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী রাখাইন দখলে থাকা আরাকান আর্মিকে কোণঠাসা করতে সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে চলতি মার্চ বা আগামী এপ্রিলে সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। এ কারণে বাংলাদেশ হয়ে রাখাইনে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠাতে চায় সংস্থাটি। তবে ঝুঁকি বিবেচনায় অনুমতি দিতে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছে বাংলাদেশ।
১৩ থেকে ১৬ মার্চ বাংলাদেশ সফর করে গেলেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। রমজান উপলক্ষে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের প্রতি সংহতির এ সফরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও যুবসমাজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। এ ছাড়া পরিদর্শন করেছেন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং ইফতারেও অংশ নিয়েছেন সেখানে।
রাখাইনে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এর প্রভাব নিয়ে গত শনিবার যৌথ ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে সফল করতে মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা পাঠিয়ে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ কারণে পরিস্থিতি অনুকূল হলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মানবিক সহায়তা পাঠানোর সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করেছি। তবে অবশ্যই এ বিষয়ে মিয়ানমারে সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
তবে বাংলাদেশ হয়ে রাখাইনে যাওয়ার করিডোর প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে মো. তৌহিদ হোসেন জানান, এ নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি অপারেশনাল, যা জাতিসংঘের স্থানীয় অফিসের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
জাতিসংঘ বলছে, রাখাইনে মানবিক সহায়তা না পাঠানো হলে সেখানে থাকা বাকি জনগোষ্ঠীর খাদ্য অনুসন্ধানে প্রতিবেশী দেশে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। আর এবার শুধু রোহিঙ্গারাই নয়, রাখাইনের বাকি জনগোষ্ঠীরও প্রবেশের শঙ্কা রয়েছে। করিডোরটিকে মানবিক ক্ষেত্রে ত্রাণ পাঠানোর জন্য চিহ্নিত করা হলেও এটি বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যেখানে আরাকান আর্মিকে কোণঠাসা করতে সব সরবরাহ আটকে দিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার; সেখানে বাংলাদেশ হয়ে যে ত্রাণ যাবে, তা রাখাইনের বেসামরিক নাগরিকদের কাছে পৌঁছাবে, নাকি আরাকান আর্মি সেগুলো দখলে নেবে– তার নিশ্চয়তা ঢাকার কাছে নেই।
এমনিতে আয়োজন করে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে গিয়ে এক প্রকার হিমশিম খেতে হয় জাতিসংঘের। এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের চাহিদার পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। ফলে রাখাইনে যে মানবিক সহায়তা পাঠানোর কথা ভাবা হচ্ছে, তা হবে অপ্রতুল। সেখানে থাকা যেসব নাগরিক ত্রাণ পাবেন না, তাদের ত্রাণের উৎসে পৌঁছে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
এ অঞ্চলটি বিশ্বে মাদক, অবৈধ অস্ত্র এবং নারী ও শিশু পাচারের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। করিডোর দিলে মাদক বা অবৈধ অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা থাকবে। এ ছাড়া মিয়ানমারের রাখাইনে বর্তমানে কোনো স্বীকৃত প্রশাসন নেই। ফলে সেখানকার অস্বীকৃতদের সঙ্গে কোনো ধরনের দরকষাকষির আলাদা ঝুঁকি রয়েছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তো রয়েছেই। এ ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশের ওপর ভরসা না করে প্রতিবেশী অন্যান্য দেশেও সম্ভাবনা অন্বেষণ করার পরামর্শ বাংলাদেশের।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সার্বিক দৃষ্টিকোণে মানবিক করিডোর নিয়ে ধীরে চলো নীতিতে রয়েছে ঢাকা। একটি চালান যেতে দিলেও দ্বিতীয়টিতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ‘কেস টু কেস’ আবেদনগুলো বিবেচনা করবে।
মহাসচিবের সফরে করিডোর নিয়ে কোনো নিশ্চিত ফলাফল না পেলেও রোহিঙ্গাদের জন্য ২০২৫ সালের আসন্ন তহবিল সংগ্রহ জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের (জেআরপি) বৈশ্বিক আবেদন জানিয়ে গেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদান এমনিতেই কমে আসছে। এর মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা অনুদান অনেক কমে গেছে। ফলে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) জনপ্রতি রোহিঙ্গার খাদ্য বরাদ্দ অর্ধেক করে দিয়েছে, যা ১২ ডলার থেকে ৬ ডলারে নেমেছে। বাংলাদেশ সফরে তহবিল সংকটের সার্বিক ঝুঁকি তুলে ধরে বিশ্বকে অনুদান বাড়াতে আবেদন করেছেন আন্তোনিও গুতেরেস। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের আগপর্যন্ত বৈশ্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
৫ আগস্টের গণঅভুত্থ্যানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন বাংলাদেশ সফর করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। বাংলাদেশ যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ফলে জাতিসংঘ শান্তি, জাতীয় সংলাপ, আস্থা ও নিরাময়ে সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। সবার জন্য একটি টেকসই ও ন্যায়সংগত ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কাজ করে অবিচল অংশীদার হিসেবে জাতিসংঘের ওপর নির্ভর করতে বাংলাদেশিদের আহ্বান জানিয়েছেন আন্তোনিও গুতেরেস। রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার সময় নিজ সুবিধার জায়গা থেকে নিজ অবস্থান তুলে ধরেছে। তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে উত্তরণের স্বার্থে নিজদের মধ্যকার মতানৈক্য দূর করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি জটিল বিবেচনায় গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের স্বার্থে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নাগরিক সমাজের সংলাপ অব্যাহত রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন আন্তোনিও গুতেরেস। এ সংলাপ যেন শুধু আলোচনার স্বার্থে না হয়, সংলাপকে হতে হবে কার্যকর পদক্ষেপের জন্য বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আলোচনায় মহাসচিব ধারণা পেয়েছেন, দীর্ঘদিনের দুঃশাসনের ফলে কাঠামোগত পরিবর্তন হলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। ফলে নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ বাংলাদেশের জনগণের ঝুঁকি বেড়ে গেছে।