রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে ৮ ঘণ্টা অবরোধ, দুর্ভোগ

প্রকাশিত: ৩:৫৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪

ঢাকা প্রতিনিধি:

ছয় দফা দাবিতে টানা ৮ ঘণ্টা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সাতরাস্তা সড়ক অবরোধ করে রাখেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। গতকাল সোমবার তাদের আকস্মিক এ অবরোধে স্থবির হয়ে পড়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা। রাজধানীজুড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন রোগী ও বিদেশগামী যাত্রীরা। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে আন্দোলন প্রত্যাহার করে সড়ক ছাড়েন শিক্ষার্থীরা।

‘কারিগরি ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনরত পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন কারিগরি প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। তারা এ সময় সাতরাস্তার মোড়সহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন। মগবাজার থেকে মহাখালী ফ্লাইওভার ও নিচের সড়ক এবং এফডিসি থেকে হাতিরঝিলের মুখ ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে তারা অবস্থান নেন। এতে চতুর্দিকের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর ২টার আগ পর্যন্ত কোনো জরুরি সেবার গাড়িসহ অ্যাম্বুলেন্সও চলাচল করতে দেননি অবরোধকারীরা। তীব্র গরমের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। অনেকে জরুরি কাজ থাকায় হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মগবাজার-মহাখালী সড়ক বন্ধ থাকায় পুরো নগরীতে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের পল্টন, শান্তিনগর, হাতিরঝিল, কাকরাইল, মিন্টো রোড, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মহাখালী, বিজয় সরণিসহ আশপাশের এলাকায় অসহনীয় যানজট চোখে পড়ে। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সাতরাস্তা মোড়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দেখা যায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের অনুরোধ করছেন এফডিসি সড়কে আটকা পড়া তাদের বহনকারী বাসটি ছেড়ে দিতে। এর আগে আন্দোলনকারীদের অনুরোধ করলেও তারা ছাড়েনি। পরে সেনাসদস্যদের অনুরোধে একপর্যায়ে বাসটি ছেড়ে দেন অবরোধকারীরা।

সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নিলে তাদের নিরাপত্তায় সক্রিয় দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের। পরে বেলা সাড়ে ৩টায়ও রাস্তা না ছাড়লে সেনাসদস্যরা সাতরাস্তায় অবস্থান নেন। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অনুরোধে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সড়কের এক লেন খুলে দেন শিক্ষার্থীরা। এতে যান চলাচল কিছুটা শুরু হয়।
এর আগে রমনা ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের পাশ থেকে ওঠা মগবাজার ফ্লাইওভারের মুখেই অবস্থান নেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। এরপর ফ্লাইওভারের ওপরে সোনারগাঁও হোটেলের দিকে নেমে যাওয়া র‌্যাম্পের মুখেও তারা অবস্থান নিয়ে গাড়িগুলো মহাখালীর দিকে যেতে বাধা দেন।
ফ্লাইওভারের নিচে এফডিসি মুখ ও হাতিরঝিলের মুখেও তারা অবস্থান নেন। এতে কার্যত অচল হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। ফ্লাইওভারের ওপরে ও নিচে সবখানেই অচল হয়ে পড়ে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পথচারীদের কথাকাটাকাটির ঘটনাও ঘটেছে।

মিন্টো রোড এলাকায় একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে মগবাজার আদ-দ্বীন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে যানজটে আটকা পড়ে। ডিবি অফিসের সামনে থেকে অ্যাম্বুলেন্সের মাইকে রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য ঘোষণা দেওয়া হলেও কেউ সাড়া দেয়নি। ধীরে ধীরে মিন্টো রোডের মুখে এসে উল্টো সড়কে ছুটে অ্যাম্বুলেন্সটি। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের উল্টোপাশে পৌঁছালে শিক্ষার্থীরা গাড়িটি আটকে দেয়। অনুরোধের এক পর্যায়ে তারা সেটি ছেড়ে দেয়।

মগবাজার মোড়ে গাজীপুর পরিবহনের চালক আরাফাত আলী বলেন, মালিবাগ মোড়ে দুপুর ১টার পর যানজটে পড়ি। এখন বিকেল ৩টা মগবাজার মোড় পর্যন্ত এসেছি। গাড়ির সব যাত্রী নেমে গেছে। গাড়ি ঘুরে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। জানি না কখন এই মগবাজার মোড় পার হতে পারব। আজকে সকালে একটি ট্রিপ নিয়ে গাজীপুর থেকে আসি। আর একটু ট্রিপ নিয়ে গাজীপুর ফিরে যাওয়ার পথে এখানে আটকা পড়ি।

ক্ষুব্ধ এই চালক বলেন, কদিন আগে শিক্ষার্থীদের একটা আন্দোলন গেল। এখনই আবার রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। জীবন আর চলে না। আজকে গাড়ির জমার টাকায় তুলতে পারিনি। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে মালিকের জমার টাকা দিতে হবে। গাড়ি নিয়ে বের হওয়া দু’জনের পরিবার না খেয়ে থাকবে। আমরা পরিবহন শ্রমিকরা এই কশাঘাত থেকে মুক্তি চাই। আমরা কাজ করে দু’মুঠো খেয়ে বাঁচতে চাই।

এফডিসির সামনে যানজটে আটকা থাকা প্রাইভেটকার চালক নাফিস রায়হান বলেন, উত্তরা থেকে দুপুর ১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশে এটি ভাড়া নিয়ে বের হয়েছি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে আসছি। মহাখালী পার হয়ে ফার্মগেট এলাকায় পৌঁছাতেই যানজটে পড়ি। সিগন্যাল মনে করে বসে আছি। দেড় ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও গাড়ি আর সামনের দিকে যায় না। আন্দোলনের খবরে যাত্রী নেমে হাঁটা শুরু করেন। আমি এখানে আটকা পড়েছি।

ফ্লাইওভারের ওপরে কথা হয় আন্দোলনকারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, এর আগে একাধিকবার প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন ও বোর্ডের প্রশাসকদের কাছে দাবি-দাওয়া তুলে ধরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কখনও আন্দোলনে নামা হয়নি। আজকে হঠাৎ বড় ভাইদের ডাকে রাস্তায় নেমে এসেছি।
ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলাম বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা ছাড়ার সুযোগ নেই। পলিটেকনিক চলবে তাদের ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে; কিন্তু এখন সাধারণ বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করে আসা শিক্ষকরা তাদের পাঠদান করছেন। এতে কারিগরি শিক্ষার গুণগতমান খারাপের দিকে যাচ্ছে।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রুহুল কবির খান  বলেন, সড়ক অবরোধ করে দিনভর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সন্ধ্যার আগে শিক্ষা সচিবের আশ্বাসে বন্ধ হয়। সর্বশেষ সাড়ে ৬টার দিকে রাস্তা ছেড়ে দেন আন্দোলনকারীরা। পরে ধীরে ধীরে সড়ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

এদিকে, বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত তেজগাঁওয়ের ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগারি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা। এ সময় তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন তারা।
বৈঠক শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহমদ  বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা বৈঠক হয়েছে। তাদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়াগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয় শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি
২০২১ সালের বিতর্কিত নিয়োগপ্রাপ্ত সব ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরকে কারিগরি অধিদপ্তর এবং সব প্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুত স্থানান্তর করতে হবে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চার বছর মেয়াদি নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রতি সেমিস্টার (পর্ব) পূর্ণ মেয়াদের (ছয় মাস) করতে হবে। উপসহকারী প্রকৌশলী পদে (দশম গ্রেড) ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ব্যতীত অন্য কেউ আবেদন করতে পারবেন না এবং উপসহকারী প্রকৌশলী ও সমমান পদ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সংস্কার করে কারিগরি সেক্টর পরিচালনায় কারিগরি শিক্ষাবহির্ভূত কোনো জনবল থাকতে পারবে না। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের বিতর্কিত নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করে সব শূন্য পদে কারিগরি জনবল নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষক সংকট দূর করতে হবে। উচ্চ শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য প্রস্তাবিত চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শতভাগ সিট নিশ্চিত করতে হবে।