নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের দাবিতে অনড় রয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ঐক্য রক্ষায় একতরফা নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের মাধ্যমে অপসারণে ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপতিকে সরাতে বিএনপিকে আস্থায় আনার চেষ্টা চলছে। নাগরিক কমিটি সূত্র সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
গতকাল শুক্রবার জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক করেছে নাগরিক কমিটির নেতারা। আগের দিন বিএনপির সঙ্গে হয়েছে প্রাথমিক আলোচনা। এসব বৈঠকের সত্যতা স্বীকার করেছেন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা তিনি জানাননি। সমকালকে বলেছেন, কয়েক দিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। রাষ্ট্রপতি এবং সংবিধান বহাল রাখার কোনো কারণ নেই।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল দেশে ফিরেছেন। তাঁর উপস্থিতিতে আরেক দফা বৈঠক হবে বলে জানিয়েছেন নাসীরুদ্দীন। এদিকে গতকাল রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে অন্তর্র্বতী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা সরকার-ঘনিষ্ঠ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। তবে এদিন সরকারের দিক থেকে রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়ে কোনো বক্তব্য আসেনি।
জামায়াত সূত্র জানায়, তারাও রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের পক্ষে। তবে বিএনপির অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের মনোনীত সাহাবুদ্দিনের বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলছে না। জামায়াতের একজন নির্বাহী পরিষদ সদস্য সমকালকে বলেছেন, রাষ্ট্রপতির অপসারণে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে, এ আশঙ্কায় বিএনপি রাষ্ট্রপতিকে আপাতত সরাতে চাইছে না। বিএনপির এ অবস্থানের কারণে জামায়াতও কিছু বলতে পারছে না। ৫ আগস্টের পর এমনিতেই নানা ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে, রাষ্ট্রপতির অপসারণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে বিপরীত অবস্থান নিয়ে সম্পর্কে আরও খারাপ করতে চাইছে না জামায়াত। বিএনপি সূত্র জানায়, দলটি রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যুতে এখনও আগের অবস্থানেই রয়েছে।
নাগরিক কমিটির সদস্য আলাউদ্দিন মোহাম্মদ সমকালকে বলেছেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সব শক্তির ঐক্য আরও গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই ঐক্য ধরে রেখেই যা করার করবে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই। এ বক্তব্যের পর সরকার এবং অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতৃত্ব তীব্র প্রক্রিয়া দেখায়। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, রাষ্ট্রপতি মিথ্যা বলে শপথ ভঙ্গ করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি একই অবস্থান নিয়েছে।
সংগঠন দুটির নেতারা নিজেরা বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভে না গেলেও সমভাবাপন্নদের ব্যানারে গত বুধবার রাষ্ট্রপতির বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ হয়। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাই তাদের ফিরিয়ে আনেন। আগের দিনগুলোর মতো গতকালও বঙ্গভবনের সামনে ছিল কঠোর নিরাপত্তা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নেতাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহার গতকালও রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ এবং সংবিধান বাতিলের কথা লিখেছেন সামাজিক মাধ্যমে। শেখ হাসিনার মনোনীত রাষ্ট্রপতির কাছে এবং আওয়ামী লীগের কাটছাঁট করা সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণের জন্য আসিফ নজরুলকে দায়ী করেছেন তিনি।
তবে গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিন সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম খান এবং সালাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়ে দেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। বিএনপি সাংবিধানিক সংকট তৈরির বিপক্ষে।
রাজনৈতিক সূত্রগুলোর ভাষ্য, বিএনপির আশঙ্কা সাহাবুদ্দিনের অপসারণে ড. ইউনূস রাষ্ট্রপতি হলে ক্ষমতার ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে। অন্তর্র্বতী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হতে পারে। যদিও সরকারের তরফে কখনোই বলা হয়নি কে হতে পারেন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি। গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর জানানো হয়– তাড়াহুড়া নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অপসারণে সিদ্ধান্ত হবে।
সরকারি সূত্রের ভাষ্য, রাষ্ট্রপতিকে সরানোর বিষয়ে সরকারও অনড় অবস্থায় রয়েছে। রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে করা হবে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত সম্মত না হলে পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। তবে এ ইস্যুতে শক্ত অবস্থান নিয়ে ফেলায় সরকারের এবং অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের পিছিয়ে আসার সুযোগ কম। নয়তো সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। তাই শেষ সময় পর্যন্ত চেষ্টা করা হবে বিএনপিকে সম্মত করাতে। তবে শেষ বিকল্প হবে, সরে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে ‘সেফ এক্সিট’ দেওয়া। এ ক্ষেত্রে তিনি দেশ ছাড়ার পর পদত্যাগপত্র পাঠাবেন।
রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি আইনি দায়মুক্তি ভোগ করেন। তিনি পদে থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা করা যায় না।
নাগরিক কমিটির একটি সূত্র জানায়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেশে ফেরার পর রাষ্ট্রপতির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। অন্তর্র্বতী সরকারকে দৃঢ় সমর্থন দিচ্ছেন তিনি এবং সেনাবাহিনী। রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যুতেও একই রকম সমর্থন পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। পরে যোগ দেন যুবলীগে। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক পদে থাকা অবস্থায় সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। অবসরের পর পাবনা-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন দুই দফা। এমপি হতে না পারলেও রাষ্ট্রপতি পদে তাঁর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া ছিল অনেকের কাছেই বিস্ময়ের।
অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া অনেকেই রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবিকে সমর্থন করছেন না। তাদের যুক্তি, রাষ্ট্রপতিকে এভাবে সরিয়ে দেওয়া হলে শেখ হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া যারা অভ্যুত্থানে সমর্থন করেছিলেন, তাদের কাছে খারাপ বার্তা যাবে। পরবর্তী সময়ে আরও অনেককে সরানোর দাবি উঠবে।
সেনাপ্রধানকে ড. ইউনূস সরিয়ে দেবেন এমন গুজবও ছড়িয়েছে, যা ইতোমধ্যে খণ্ডন করেছে সরকার। আলাউদ্দিন মোহাম্মদ সমকালকে বলেছেন, সেনাপ্রধান ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সামরিক মহানায়ক। তাঁর এবং সেনাবাহিনীর বৈপ্লবিক ভূমিকা অভ্যুত্থানকে সফল করেছে। সুতরাং, সেনাপ্রধানের অপসারণের দাবি উঠতে পারে– এমন আশঙ্কা ভিত্তিহীন, অমূলক।