রাজনৈতিক সংঘর্ষ নিলো বাবার প্রাণ, মায়ের লড়াই থামলো সড়কে
একা হয়ে গেলো মেঘ

নাটোর প্রতিনিধি:
এক দশক আগে রাজনৈতিক সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মেঘের বাবা সুজন আলী। সেই থেকে মা-ই শিশুটিকে আগলে রেখেছিলেন। শিশুটিকে মানুষ করতে মা মাসুমা আক্তার বেচে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশা। মাসুমার সেই লড়াইটিও থেমে গেল সড়কে।
জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়ে সুদিনের স্বপ্ন দেখতেই সড়ক দুর্ঘটনায় দুমড়ে মুচড়ে গেল সাংবাদিক মাসুমার জীবনের লড়াই। বাবার পর মাকে হারিয়ে একা হয়ে গেল একমাত্র ছেলে মেঘ (১২)।
মাসুমা আক্তার (৩২) বেসরকারি ‘এখন’ টেলিভিশনের রাজশাহী ব্যুরো অফিসের সাংবাদিক ছিলেন। রাজশাহী বিভাগীয় শহরে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী সাংবাদিক। মাসুমা গুরুদাসপুর পৌর শহরের নারায়ণপুর গ্রামের আব্দুল জব্বারের মেয়ে। ওই গ্রামের কবরস্থানেই মঙ্গলবার বিকেলে মাসুমা আক্তারকে দাফন করা হয়েছে। দাফনের সময় সেই কবরস্থানের প্রাচীর ধরে পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিল ছেলে মেঘ। তবে মেঘের চোখে অশ্রু ছিল না। ফ্যাল-ফ্যাল করে নির্বাক চোখে তাকিয়ে ছিল সে।
সাংবাদিক মাসুমার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মাসুমারা দুই ভাইবোন। বাবা আব্দুল জব্বার ছিলেন সাবেক সেনাসদস্য। গুরুদাসপুরের বেগম রোকেয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষে ২০১২ সালে বিল বিল চলন শহীদ শামসুজ্জোহা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন মাসুমা।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, মাসুমা যখন একাদশ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়। স্বামী ছিলেন নাটোরের কানাইখালী এলাকার সাইফুজ্জামান। এই দম্পতির ঘরে আসে ছেলে মেঘ। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বরের সকালে মাসুমার সুখের সংসারে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। নাটোর শহরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন মাসুমার স্বামী ছাত্রদল নেতা সাইফুজ্জামান সুজন।
মাসুমার মা রেহেনা বেগম ইত্তেফাককে জানালেন, মেয়ে জামাইয়ের মৃত্যুর পর মেয়ে তাদের সংসারে ফিরে এসে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। আবার লেখা পড়া শুরু করে রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতক শেষ করেন। সেখানে পড়া অবস্থায় সাংবাদিকতা শুরু হয় মাসুমার।
প্রতিবেশীরা জানান, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষে সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে নেন মাসুমা। রাজশাহী শহরে একাধিক অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন। এর পর ১০১৪ সালে ‘এখন’ টেলিভিশনের রাজশাহী ব্যুরো অফিসের রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। ছেলে মেঘকে ভর্তি করিয়ে দেন রাজশাহী শহরের একটি আবাসিক বিদ্যালয়ে। মেঘ এবার অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে।
মাসুমার স্মৃতি হাতরে কাঁদছেন মা রেহেনা বেগম। বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘এখন’ টেলিভিশনে চাকরি পাওয়ায় সুখ ফিরেছিল মাসুমার। প্রায়ই বলতো-‘ অনেক বড় চ্যানেলে চাকরি পাইছি মা, তুমি চিন্তা কাইরো না। ছেলেকে মানুষের মত মানুষ বানাতে পারবো।’ মেয়েটি আমাকে ছেড়ে চলে গেল। এখন কী নিয়ে থাকব। কী হবে নাতি মেঘের।’
পারিবাকি সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩ সালে শেষের দিকে সৈকত নামের এক যুবককে দ্বিতীয় বিয়ে করেন মাসুমা। তিনি রাজশাহীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ ননদকে দেখতে কুমিল্লায় যাচ্ছিলেন। বাস থেকে নেমে স্বামী স্ত্রী মিলে ঢাকা-কুমমিল্লা মহাসড়কের নূরজাহান হোটেলের উল্টো দিকে সিএনজি ঠিক করছিলেন। এ সময় দ্রুতগ্রামী একটি বাস সিএনজিটিকে ধাক্কায় দেয়। এতে সড়কে ছিটকে পড়েন মাসুমা ও সৈকত। আহত হন সিএনজি চালকও। এরমধ্যে মাসুমার অবস্থা গুরুতর হয়।
প্রথমে তাদের কুমিল্লা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিত্সার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সেখানে আইসিইউ শয্যা না পাওয়ায় নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে মাসুমা আক্তার না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
এখন টিভির রাজশাহী অফিসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রাকিবুল হাসান বলেন, পরিশ্রমী ও বিনয়ী স্বভাবের সাংবাদিক ছিলেন মাসুমা আক্তার। মাসুমার মৃত্যু নিয়ে ছেলে মেঘের ভবিষত্ নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চটা দিয়ে সবার মনে জায়গা নেওয়ায় মাসুমার মৃত্যুতে শোকাতুর হয়েছে রাজশাহীর সাংবাদিক মহল।