সাজ্জাদ হোসেনঃ
অসুস্থতার কারণে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ছেলের বাসায় থাকতে হচ্ছে রওশন আরা বেগমকে। তার বয়স ৭০। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও বার্ধক্যজনিত বাতব্যথা রোগে আক্রান্ত তিনি। চিকিৎসক বলেছেন প্রতিদিন তাকে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটতে। কিন্তু শহরের বাসায় হাঁটার মতো জায়গা নেই, বাসার বাইরে হাঁটতে একা যেতে ভয় পান তিনি। বলেন, ‘রাস্তার পাশের ফুটপাতে অনেক সময় বাইক তুলে দেয়। তাছাড়া ফুটপাতগুলো চওড়া না। অনেক জায়গা ভাঙা আবার হকাররা ফুটপাত দখল করে রাখে। এসব কারণে ভয়ে হাঁটতে যেতে পারি না। ফলে শুধু ওষুধের ওপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে, অথচ চিকিৎসক শুধু হাঁটতে বলেন।’
রাজধানী ঢাকা বা অধিকাংশ শহরের মানুষ রওশন আরা বেগমের মতোই ইচ্ছা থাকলেও হেঁটে চলাচল করতে পারেন না এসব সমস্যার কারণে। চিকিৎসকেরা বলছেন, নগরে সুস্থ জীবনযাপনে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। নগরে প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মুটিয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ওজনসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ছে। তারা বলছেন, শহরের অধিকাংশ মানুষ হেঁটে চলাচল করতে চাইলেও ঢাকা শহরের যাতায়াত পরিকল্পনায় হাঁটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না। ফলে রোগ প্রতিরোধ, যানজট হ্রাস ও পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হাঁটার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি।
স্বাস্থ্যসেবা নগর-গ্রাম সর্বত্র সব মানুষের মৌলিক অধিকার। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা নয়, রোগ প্রতিরোধই মুখ্য। বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নগরে বাস করছে। বাংলাদেশেও নগরে মানুষের আগমন ঘটছে, বাড়ছে দ্রুতহারে জনসংখ্যা। তাই নগরে সুস্থ জীবনযাপনে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
চিকিৎসকেরা বলছেন, প্রতিদিন ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা হাঁটার মাধ্যমে হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ অতিরিক্ত ওজন ও মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করা সম্ভব। নিত্যদিনের যাতায়াতের ক্ষেত্রে হেঁটে চলাচলের মাধ্যমে এই সুবিধা অর্জন করা যায়। এর জন্য ঢাকাসহ দেশের সব শহরে হাঁটার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, প্রথমত, হাঁটার জন্য প্রয়োজন সুস্থ শরীর। আর শরীর নামক যন্ত্রটিকে সুস্থ রাখতে একে প্রতিদিন কাজ করাতে হবে। এই কাজ করাটা হচ্ছে—আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালোরিসম্পন্ন খাবার গ্রহণ করি, সেই পরিমাণ ক্যালোরি খরচ করার জন্য আমাদের কাজ করতে হয়। যেহেতু শহরের সংস্কৃতিতে একটা বড় অংশের মানুষ কায়িক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত নয়, সে কারণে তাদের আমরা হাঁটতে বলি। এর বাইরে হৃদরোগে যারা আক্রান্ত, তারা যদি নিয়মিত হাঁটে, তাহলে রক্ত চলাচল বেড়ে গেলে হৃদপিণ্ডের রক্তবাহী ধমনিগুলো সচল থাকে এবং ফ্যাট জমে সেগুলো বন্ধ হয় না বা ব্লক হয় না। শুধু এটাই নয়, আমাদের শরীরটা হাড় দিয়ে তৈরি, চলাফেরা করার মধ্যে হাড়ের এই জোড়াগুলো সচল থাকে এবং মাংসপেশিগুলো সবল হয়, শরীর সক্রিয় থাকে। ফলে রোগবালাই কম হয়। আমরা জানি, কেউ যদি নিয়মিত হাঁটে, তাহলে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ—এগুলো কম হবে। সব মিলেই আমরা বলি, হাঁটা ভালো এবং রোগ কম হয়। শরীরটা যখন সবল থাকে, তখন রক্তবাহী ধমনিগুলো সচল থাকে, ফলে স্ট্রোক কম হয়, দুশ্চিন্তা দূর হয়, মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষমতা বাড়ে। কেউ কেউ বলছেন, প্রতিদিন ১০ হাজার স্টেপ হাঁটতে হবে একজন সাধারণ সুস্থ মানুষকে। যারা রোগাক্রান্ত, তাদের আমরা প্রয়োজন এবং রোগের ধরন বুঝে হাঁটতে বলি, যেমন ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে যারা সুস্থ-সবল, তাদের প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে হাঁটতে বলি। আবার একটু দুর্বল হলে তাকে ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট হাঁটতে বলি। এজন্য বয়স, রোগ, সুস্থতা, অসুস্থতার ওপর ভিত্তি করে আমরা হাঁটার পরিমাণটা নির্ধারণ করি। তবে একজন সুস্থ মধ্যম বয়সের মানুষ দিনে ১০ হাজার স্টেপ বা ৩৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা হাঁটলে ভালো বলে জানান।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ঢাকায় ৭৬ ভাগ যাতায়াত হয় পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে, যার অর্ধেক আবার দুই কিলোমিটারের কম। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এই দূরত্বে অধিকাংশ মানুষের হেঁটেই যাতায়াত করা সম্ভব। কিন্তু ঢাকা শহরে সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়াই নির্মিত অবকাঠামো, যান্ত্রিক যানের ব্যবহার বৃদ্ধি, ফুটপাত ভেঙে ফেলা, ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং ও কনস্ট্রাকশনের জিনিসপত্র-ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা, রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজের ব্যবস্থা করাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ মানুষকে হাঁটতে নিরুত্সাহিত করছে। ঢাকায় গাড়ির হর্ন-শব্দ, বায়ুদূষণ আর দুর্ঘটনার ভয় মানুষকে হাঁটতে শঙ্কিত ও নিরুত্সাহিত করছে।
এই পরিবেশবিদ আরও বলেন, হাঁটার জন্য প্রয়োজন নিরাপদ ও আকর্ষণীয় মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ। হাঁটার জন্য ফুটপাত প্রশস্ত এবং সমতল হওয়া প্রয়োজন। ফুটপাতের পাশে গাছ লাগানো এবং পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখাও জরুরি। হাঁটার জন্য শুধু ফুটপাতের উন্নয়ন করলেই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে রাস্তা পারাপারেও হেঁটে চলাচলকারীদের প্রাধান্য দিতে হবে। সহজে হাঁটার জন্য ফুটওভারব্রিজ নয়, সারা শহরের জ্রেবা ক্রসিং প্রয়োজন বলে জানান। এছাড়া ফুটপাতে হকারদের সুষ্ঠুভাবে বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে মানুষকে হেঁটে চলাচলে আকর্ষণ ও নিরাপত্তা প্রদান করা সম্ভব। এর মাধ্যমে সস্তায় জিনিসপত্র ক্রয় এবং প্রচুর মানুষের স্বল্প বিনিয়োগে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।