শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মার্কিন নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
আন্তর্জাতিক ডেস্ক রিপোর্টঃ
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। ঘটছে নির্বিচার আটকের ঘটনাও। এই আন্দোলনে এখন পর্যন্ত ২ হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে পুলিশ। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো। দুঃখজনকভাবে এমন এক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে অশান্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, যখন গাজা যুদ্ধ বিরতি একপ্রকার ঝুলে গেছে!
জানিয়ে রাখতে হয়, মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) রাতে লস অ্যাঞ্জেলেসে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় ইসরায়েলপন্থী মুখোশধারী এক গোষ্ঠী বিক্ষোভকারীদের তাঁবু লক্ষ্য করে হামলা চালালে বাতিল হয়ে যায় ক্লাস। পুলিশ ডাকা হয় ক্যাম্পাসে। পুলিশ এসে বিক্ষোভকারীদের তাঁবু গুঁড়িয়ে দেয়। অনেকটা একই চিত্র ছিল নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিক্ষোভকারীরা প্রশাসনিক ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিলে পুলিশের হস্তক্ষেপে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। আটক হন অনেক শিক্ষার্থী।
আমরা লক্ষ করেছি, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রদের বিক্ষোভ থামানোর জন্য শত শত দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট নেমাত শফিক ঘোষণা করেন, ‘এই পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া আমার হাতে কোনো বিকল্প নেই।’ পরিস্থিতি কতটা বেগতিক, তা বোঝা যায় এ থেকেই।দ্বিমত নেই, গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়া ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে একধরনের উত্তেজনা বয়ে এনেছে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এ নিয়ে একপ্রকার অস্বস্তিতে রয়েছেন ডেমোক্র্যাটরা। উপরন্তু এক অজানা ভয়ও মাথাচাড়া দিচ্ছে এই প্রশ্নে যে, তরুণদের মধ্যে দানা বাঁধা ক্ষোভ আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে কি না। এ নিয়ে জোর আলোচনাও শুরু হয়ে গেছে।
দ্য ইকোনমিস্ট এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে ‘ক্যাম্পাসে জো বাইডেনের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে তরুণ ছাত্ররা’। একই ধরনের শিরোনাম করেছে পিবিএস—‘গাজা যুদ্ধ ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদ নভেম্বরে বাইডেনকে যেভাবে বেকায়দায় ফেলবে’।বলা বাহুল্য, এ ধরনের সংবাদ হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের বিচলিত করে তুলবে। যদিও অনেক বিশ্লেষক দাবি করছেন, ছাত্র বিক্ষোভের হাত ধরে আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সেভাবে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে ভোটে এই ঘটনার প্রভাব যে একেবারেই পড়বে না, তেমনও নয়। বস্তুত, আন্দোলনকারীদের থামাতে ব্যর্থ হলে মার্কিন ভোটারদের বড় একটা অংশ বাইডেনের বিরুদ্ধে চলে গেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি তথা বাইডেনের ওপর চলমান শিক্ষার্থী বিক্ষোভ সত্যিকার অর্থে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা হিসাব করে দেখা যাক। প্রথমেই বলে রাখা দরকার, ক্যাম্পাসগুলোতে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী বিক্ষোভে নেমেছেন, তা সামগ্রিকভাবে খুব একটা বেশি নয়। অর্থাৎ, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা মার্কিন তরুণ ভোটারদের সেভাবে প্রতিনিধিত্ব করছেন না। এর সহজ অর্থ, বিক্ষোভ অনেক প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েছে বটে, কিন্তু এতে বাইডেন বা ডেমোক্রেটিক পার্টির বিচলিত হওয়ার মতো তেমন কিছু এখন পর্যন্ত ঘটেনি।
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, কলাম্বিয়া, হার্ভার্ড, ইয়েল ও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির মতো আমেরিকার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও ব্যয়বহুল ইউনিভার্সিটিগুলোতেই কেবল বিক্ষোভ জোরালো হতে দেখা গেছে। এসব ইউনিভার্সিটিতে অভিজাত ও প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোই বেশি সক্রিয়। মার্কিন যুব জনগোষ্ঠী বিক্ষোভে সেভাবে যুক্ত হয়নি এখন অবধি। তাছাড়া মার্কিন শিক্ষার্থীদের খুব ছোট অংশই গাজা বিক্ষোভে সক্রিয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কলম্বিয়াতে ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২০০ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাতে প্রমাণিত হয়, আন্দোলনের মাঠে নেই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। উপরন্তু, এমনও জানা যাচ্ছে, বিক্ষোভকারীদের দলে ঢুকে পড়েছে বহু অছাত্র ও বহিরাগত। এর চেয়ে বড় কথা, বিক্ষোভকারীদের বেশির ভাগেরই ইসরায়েলের বিপক্ষে যুক্তিযুক্ত, শক্তিশালী বা সুগঠিত মতামত নেই। সহজ করে বললে, অগোছালোভাবে আন্দোলনে জড়ো হয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
এই আন্দোলন নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে, সে সম্পর্কে জরিপ চালিয়েছে হার্ভার্ড ইনস্টিটিউট অব পলিটিকস সার্ভে অব ইয়াং আমেরিকান। জরিপের তথ্যানুসারে, ৫১ শতাংশ মার্কিন তরুণ ভোটার ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির পক্ষে। একইভাবে, ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের প্রায় ৪১ শতাংশ ইসরায়েলের সঙ্গে আমেরিকার জোট সম্পর্কে চোখে পড়ার মতো দৃঢ় অবস্থানে নেই। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কের বিষয়ে তারা সেভাবে মাথা ঘামাতে চান না। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে।
জরিপে ওঠে এসেছে, জীবনযাত্রার ব্যয়ের মতো সাধারণ ঘরোয়া সমস্যা মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে যুব ভোটারদের মধ্যে। হার্ভার্ড আইওপি পোল অনুসারে, মাত্র ২ শতাংশ মার্কিন তরুণ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে ‘সবচেয়ে উদ্বেগজনক সমস্যা’ বলে মনে করেন। আবার জরিপে এমনও উঠে এসেছে, অনেক মার্কিন শিক্ষার্থী চলমান বিক্ষোভকে বড় করে দেখতে নারাজ।
অন্য এক জরিপে দেখা গেছে, হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামগ্রিকভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করেন ৮০ শতাংশ আমেরিকান। তবে গাজা যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটদের (এবং সামগ্রিকভাবে আমেরিকানদের) নিঃসন্দেহে সহানুভূতিও রয়েছে। ইসরায়েলকে গাজায় অভিযান না চালাতে তথা এই যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে একাধিক বার সতর্ক করেছে বাইডেন প্রশাসন।
যাহোক, ছাত্র আন্দোলন যেভাবে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে, তা যদি বাইডেন প্রশাসন ভালোভাবে ঠেকাতে না পারে, তাহলে বিপরীত পক্ষ এ থেকে ফায়দা হাসিলের সুযোগ নিতে চাইবে। মুখোশ পরিহিত এক বিক্ষোভকারী চিত্কার করে বলেছেন, ‘৭ অক্টোবরের কথা কখনই ভুলবেন না (এ দিন ইসরায়েলে চালায় হামাস)। এ ধরনের ঘটনা আরও একবার নয়, পাঁচবার নয়, ১০ বার নয়, ১০০ বার নয়, ১ হাজার বার নয়, বরং ১০ হাজার বার ঘটানো হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে দাঁড়িয়ে এ ধরনের কথা বলে পার পাওয়াটা স্বভাবতই আলোচনার জন্ম দেবে, তা আবার যদি হয় উচ্চ শিক্ষালয়ের মতো জায়গায়!বস্তুত, নির্বাচন সামনে রেখে বাইডেনের বিরুদ্ধে ক্ষেত্রবিশেষে যেসব বিক্ষোভ দেখা গেছে, ছাত্র বিক্ষোভকে তারই একটা অংশ হিসেবে ধরে নিতে চাইছেন কেউ কেউ। মিশিগানের প্রাইমারিতে আরব-আমেরিকানসহ ১ লাখের বেশি ভোটারকে ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের নীতির প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল। এরূপ অবস্থায় বাইডেন প্রশাসন যদি চলমান ছাত্র বিক্ষোভ ঠেকাতে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে না পারে, তাহলে নিশ্চিতভাবে ইহুদি ও সমমনা ভোটারদের প্রতিরোধের মুখে পড়বে ডেমোক্রেটিক পার্টি। যেসব ভোটার ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক, তারা নিশ্চয়ই মার্কিন মুলুকে ফিলিস্তিন বা গাজার সমর্থকদের বিক্ষোভ দেখতে চাইবেন না!
বিরোধী দল তথা রিপাবলিকান পার্টি অবশ্য ইতিমধ্যে বর্তমান প্রশাসনের ওপর আঙুল তুলেছেন। ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলার প্রসঙ্গ টেনে তারা প্রমাণ করতে চাইছেন, বাইডেন প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বিশৃঙ্খলা ঘনীভূত হচ্ছে। তারা এমনও দাবি করছেন, চলমান বিক্ষোভ দমনে কার্যত কিছুই করছে না বা করতে পারছে না বাইডেন প্রশাসন।
চলমান বিক্ষোভ না থামাতে পারার কারণে আপত্তি জানাচ্ছেন খোদ বাইডেন সমর্থকেরাও। হার্ভার্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ল্যারি সামারস এক পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের অনেক নেতৃস্থানীয় ইউনিভার্সিটিতে আইনের সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন একাডেমিক নেতারা। এর ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার সহযোগীরা রাজনৈতিক সুবিধা হাসিল করার সুযোগ নিতে পারেন।’
উল্লেখযোগ্য বিষয়, এক ঘোষণায় ইহুদিবিদ্বেষের নিন্দা করেছেন বাইডেন। একইভাবে, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কী চলছে, যারা তা বোঝেন না, তাদেরও নিন্দা করেছেন। বাইডেনের এভাবে উভয় পক্ষে থাকাটা স্বভাবতই পছন্দ নয় অনেকের। এ কারণে তাকে নিয়ে নানামুখী সমালোচনাও হয়েছে। অনেকে বলছেন, ‘বাইডেনের দুই পক্ষেই থাকার অর্থ হচ্ছে বিষয়টি বেশ জটিলই।’
যাহোক, আসছে নভেম্বরের ভোটে মার্কিন তরুণ ভোটাররা বাইডেনের জন্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ‘ফ্যাক্টর’। ডেমোক্র্যাটরা যদি আন্দোলনরত তরুণ ভোটারদের বাইডেনের পক্ষে আনতে ব্যর্থ হন, তাহলে কিছুটা হলেও ক্ষতি হবে বাইডেনের। অবশ্য আগেই বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন পর্যন্ত যে সংখ্যক শিক্ষার্থী আন্দোলন করছেন, তা মোট মার্কিন তরুণ ভোটারদের একটা ক্ষুদ্র অংশ। এই অবস্থায় আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শিক্ষার্থী বিক্ষোভ কতটা প্রভাব ফেলবে, তা মূলত নির্ভর করবে চলমান আন্দোলন কতদূর গড়ায়, তার ওপরে।