শিল্পবর্জ্যে বিবর্ণ ভালুকার নদী-খাল, হচ্ছে দখলও

প্রকাশিত: ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৯, ২০২৫

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি:

 

একসময় কৃষিপ্রধান উপজেলা হিসেবে খ্যাত ছিল ময়মনসিংহের ভালুকা। বর্তমানে অসংখ্য শিল্পকারখানা স্থাপন হওয়ায় পালটে গেছে উপজেলার চিত্র ও জীবনযাত্রার মান। নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পরিবেশ, নদী, খাল ও বিলেও। পাইপ ও ড্রেন দিয়ে আসা বিভিন্ন রঙের তরল বর্জ্য, বিশেষ করে শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলায় দূষিত হচ্ছে পানি। পাশাপাশি দখলের কারণে সৌন্দর্য হারাচ্ছে উপজেলার সবচেয়ে বড় খিরু নদী ও লাউতি খালসহ বিভিন্ন নদী ও খাল।

ভালুকার প্রাণ ছিল খিরু নদী। প্রচলিত আছে, নদীটির পানি সুস্বাদু ছিল বলেই খিরু নদী নামকরণ হয়েছে। একসময় এ নদীকে ঘিরেই নির্ভরশীল ছিল কৃষি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। চলত নৌকা-লঞ্চ। বর্তমানে এলাকাবাসীর ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নদীটি। শুধু খিরু নদীই নয়, লাউতির খালসহ বিভিন্ন শাখা নদীও এখন বিপন্ন। দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে রোগ-বালাই ছড়াচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। দূষিত পানি পান করে প্রায়ই মারা যাচ্ছে গরু-ছাগলসহ বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখি।

উপজেলায় প্রায় ৪ শতাধিক শিল্পকারখানার মাত্র ৩০ থেকে ৩২টিতে রাসায়নিক বর্জ্য পরিশোধনের ইটিপি প্লান্ট চালু আছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ বিকল বা ইচ্ছে করে বন্ধ রাখা হয়। খিরু নদী, মরাপোড়া, কাইয়ার খাল, বিলাইজুড়ি, জোড়াখালসহ বেশ কয়েকটি খাল ও নদীতে শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে। ইটিপি প্লান্ট আছে এমন শিল্পকারখানাগুলোর অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলার কৌশল হিসেবে আরেকটি গোপন পাইপিং ড্রেন ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, বিকাল হলেই দুর্গন্ধের মাত্রাটা বাড়ে। রাস্তা দিয়ে চলাচল করা যায় না। কয়েক বছর আগেও খিরু আর লাউতিতে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ ধরা যেত। কিন্তু এখন মাছ ধরা তো দূরের থাক, পানির দিকে তাকানোও যায় না। খারুয়ালী গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান হবি বলেন, কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে বাড়িতে থাকা যায় না। পাইপ ও ড্রেন দিয়ে আসা বিভিন্ন রঙের তরল বর্জ্য বেশির ভাগ অপরিশোধিত অবস্থায় নদীতে ফেলা হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ভরাডোবা, ভালুকা, মেদুয়ারী, হবির বাড়ী, জামির দিয়া ও কাশর এলাকায় অসংখ্য শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠেছে। এসব শিল্পকারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত তরল বর্জ্য পাইপ ও ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি কৃষিজমি ও নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে পানি বিবর্ণ হয়ে বিষাক্ত ও আলকাতরার মতো কালো হয়ে গেছে। ডাইংমিল থেকে বিরামহীন দুর্গন্ধযুক্ত ঘন কালো পানি খিরু নদীসহ সাধুয়া, খুরোলিয়া, তালতলা, কেচুরগোনা, তেইরা, হায়রা, শিমুলিয়া, লাউতি খালসহ অসংখ্য ছোট-বড় বিলে নেমে পানি বিষাক্ত হয়ে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর ক্ষতি হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে কৃষকের খেতের ফসল।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ৪৬ কিমি দৈর্ঘ্যের খিরু নদীর প্রকৃতি সর্পিলাকার। পার্শ্ববর্তী ফুলবাড়িয়া উপজেলা থেকে শুরু হয়ে ভালুকার সুতিয়া নদীতে মিশেছে এই বন খিরু। ব্যক্তি ও শিল্পকারখানার মালিকদের আগ্রাসনে দখল হয়ে যাওয়া অনেক খালই খিরু নদীর মতো ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ভালুকা আঞ্চলিক শাখার সদস্যসচিব কামরুল হাসান পাঠান কামাল জানান, শিল্পের আগ্রাসনে মরতে বসেছে খিরু নদীসহ অন্য নদ ও খাল। কিছু শিল্পমালিকদের অনৈতিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যের কারণেই এ পরিস্থিতি। এজন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কাছে ভালুকার নদী, খাল ও বিলগুলোতে আগের মতো বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিতসহ নাব্য ফিরিয়ে এনে মানুষের ব্যবহার উপযোগী করার দাবি জানাই।

এ বিষয়ে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মেজ-বাবুল আলম জানান, শিল্পবর্জ্য রোধে ও পরিবেশ রক্ষায় তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আইন অমান্য করে পরিবেশ নষ্ট করলে জরিমানাসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া শিল্পকারখানাগুলোতে অ্যাডভান্স মনিটরিং, আইপি ক্যামেরা স্থাপন, অনলাইন মনিটরিং ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে দূষণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।