শিশুরা খেলুক, শিশুরা হাসুক, শিশুরা গড়ুক আগামী

প্রকাশিত: ১২:০৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক:

শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রতিদিন ন্যূনতম এক ঘণ্টা করে খেলাধুলা ও শারীরিক সক্রিয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ন্যূনতম ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা, খেলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদি থাকা প্রয়োজন। সেই হিসেবে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য সোয়া দুই একর খোলা জায়গা এবং এক একর খেলার মাঠের প্রয়োজন।

শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা খেলার মাঠ বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়। সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধান এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া প্রচারের জন্য খেলাধুলার বিকল্প নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী যেকোনো আবাসন এলাকার ন্যূনতম ১০ ভাগ খেলার মাঠ-পার্ক প্রভৃতি বিনোদন সুবিধার জন্য বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।

অতি ঘন নগর এলাকায় প্রতি আধা বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যা বিবেচনায় ন্যূনতম একটি খেলার মাঠ থাকা প্রয়োজন। খেলার মাঠ আমাদের সামাজিকীকরণ বাড়ায় ও উদার চিত্ত হৃদয়ের মানুষ গড়তে সহায়তা করে। সমাজকল্যাণ, মনোবিদ্যা এবং অপরাধ-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর-তরুণদের দ্বারা অপরাধের মাত্রার সঙ্গে খেলার মাঠের সুবিধা, পার্কের সংখ্যা, খোলা জায়গার পরিমাণ প্রভৃতির উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক বিদ্যমান।

উন্নত বিশ্ব তথা ইউরোপ বা আমেরিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে তাদের পরিকল্পনার একটা বড় অংশ থাকে শিশুদের শিক্ষা, বিনোদন, খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে। বিশ্বের যে দেশগুলো শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠের ওপর জোর দেয় তারা প্রায়শই শিশু কল্যাণ, শিক্ষা এবং উদ্ভাবনী নগর পরিকল্পনার প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা এবং শিশুর বিকাশকে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। সংবেদনশীল এবং কল্পনাপ্রসূত খেলার জন্য প্রাকৃতিক উপকরণ অন্তর্ভুক্ত করে তারা শিশুদের জন্য উপযোগী খেলার মাঠ তৈরি করে। তারা মনে করে শিশুদের মানসিক বিকাশ এবং তাদের নিজের জীবনে ঝুঁকি এড়াতে এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে খেলার মাঠের বিকল্প নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সুপারকিলেন পার্ক (ডেনমার্ক), টিভোলি গার্ডেনস খেলার মাঠ (সুইডেন)।

আমরা অনেকেই খুঁজে থাকি বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও বসবাসযোগ্য দেশগুলোর র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা কোন দেশ। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ওইসব দেশে শিশুদের নিয়ে পাড়ি জমাতে চান। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠন হলো ইউনিসেফ। প্রতি বছর এই সংগঠনটি শিশুর সুস্থতার একটি ‘রিপোর্ট কার্ড’ তৈরি করে।

খেলার মাঠ না থাকায় শিশু-কিশোররা খুব স্বাভাবিকভাবে নিজের অজান্তেই সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল গেমসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার বাড়ছে।

জাপানে শৈশবে স্থূলতার হার সবচেয়ে কম। এর পাশাপাশি, শিশুমৃত্যুর হার কম, বায়ু ও পানি দূষণের মাত্রাও (যা শিশুদের প্রভাবিত করে) কম। এটি যেকোনো পরিবারের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ দেশগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে ট্র্যাফিক দুর্ঘটনা যেমন কম ঘটে, তেমনি যেকোনো দেশের তুলনায় জাপানে খুনের হার সবচেয়ে কম, প্রতি লাখে মাত্র দশমিক দুই জন মানুষ।

শিশুরা রাজধানী টোকিওর চারপাশে হাঁটতে পারে এবং নিজে নিজে স্কুলে যেতে পারে এবং খেলাধুলা করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম দরকার। এতে তাদের পেশি ও হাড় দৃঢ় ও মজবুত হয়।

এস্তোনিয়ায় শিশুরা কম বায়ু ও শব্দ দূষণ এবং কীটনাশকের সংস্পর্শে আসে। সেখানে খেলাধুলার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, গ্রেট ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে এস্তোনিয়ায় বেশি সবুজ স্থান রয়েছে। শিশুরাও বাড়ির কাছাকাছি খেলার মাঠ এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক সুবিধা উপভোগ করতে পারে।

এস্তোনিয়ায় কম ওজন নিয়ে শিশু জন্ম নেওয়ার হার বিশ্বের দ্বিতীয়-সর্বনিম্ন এবং প্রসূতি মায়ের প্রসবপূর্ব যতেœর গুণমানেও দেশটি বেশ এগিয়ে। এখানকার শিশুদের গণিত, বিজ্ঞান এবং ভাষাগত দক্ষতা এশিয়ার বাইরের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি।

জার্মানি শিক্ষা দর্শনের পাশাপাশি খেলার মাঠের ফোকাস বেশি দেয়। অ্যাডভেঞ্চার খেলার মাঠ নির্মাণ এবং সৃজনশীল স্বাধীনতা প্রচার করায় জার্মানি অনেক এগিয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিদের্শনা মেনে তারা তৈরি করেছে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ। সেখানে তারা মূলত শিশুর মানসিক বিকাশ ও সৃজনশীল দক্ষতা তৈরিতে অধিক মনোযোগ দেয়।

সিঙ্গাপুর উদ্ভাবনী শহুরে নকশার সাথে শিক্ষাকে একীভূত করার জন্য খেলার মাঠকে বিশেষ বিবেচনায় নেয়। শহুরে পার্কে থিমেটিক খেলার মাঠ, শারীরিক এবং জ্ঞানীয় চ্যালেঞ্জের সমন্বয় ঘটায়, যেমন বে চিলড্রেনস গার্ডেন।

এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই যে শিশু-কিশোরদের মধ্যে জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির বীজ লুকায়িত থাকে। তাদের প্রতি অবহেলা করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুখ থুবড়ে পড়বে। খেলার মাঠ না থাকায় শিশু-কিশোররা খুব স্বাভাবিকভাবে নিজের অজান্তেই সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল গেমসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার বাড়ছে।

ইংল্যান্ডের পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের গবেষণা থেকে জানা যায়, ‘যেসব শিশু কম্পিউটার, টেলিভিশন ও ভিডিও গেমস নিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকে, তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও হীনম্মন্যতায় ভোগে। এসব শিশুরা অন্যদের সঙ্গে মিশতে চায় না বা ঠিকমতো পারে না। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও ঠিকমতো কথা বলে না, নিজেদের দৈনন্দিন কাজগুলোও তারা করতে পারে না। অনেক সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারায় এদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়।’ শিশু-কিশোরদের অটিজম, মনোযোগ হ্রাস, হতাশা ও তীব্র বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে ভিডিও গেম আসক্তির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

আমরা প্রায় সবাই শিশুদের মানসিক বিকাশের বিষয়ে সচেতন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্র, শিশুর মানসিক বিকাশে অধিকভাবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। কীভাবে একটি শিশু তার মেধা, মনন ও মানসিকতায় বেড়ে উঠতে পারে সেই গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বের অসংখ্য রাষ্ট্র শিশুদের জন্য খেলার মাঠ তৈরি করে চলেছে। যেসব দেশ মূলত খেলার মাঠ তৈরি করে চলেছে তারা বুঝতে পেরেছে যে একটি জাতি শিশুদের গুরুত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে কীভাবে নিজেদের এগিয়ে নিতে পারে।

বাংলাদেশে বেশিরভাগ বিদ্যালয়ের সামনে খোলা জায়গা না থাকায় কোমলমতি শিশুরা ছোটাছুটি করতে বা দৌড়াতেও পারে না। শিশুরা মা-বাবার হাত ধরে এসে ক্লাসরুমেই প্রবেশ করে এবং ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে যায়।
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মহল থেকে খেলাধুলার গুরুত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা-বিবৃতি আমরা শুনে থাকি। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এ বিষয়ে অনেক দেশেরই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না বললেই চলে। এমনকি শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বারবার অভিভাবকদের তাদের শিশুদের বাইরে খেলাধুলা করতে উৎসাহিত করার আহ্বান জানালেও এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উদাসীন থাকে কর্তৃপক্ষ।

শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে সহায়ক হবে এমন কার্যক্রম যেভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা সেভাবে হয় না, তাই সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ হয় না যথাযথভাবে। বাংলাদেশে বেশিরভাগ বিদ্যালয়ের সামনে খোলা জায়গা না থাকায় কোমলমতি শিশুরা ছোটাছুটি করতে বা দৌড়াতেও পারে না। শিশুরা মা-বাবার হাত ধরে এসে ক্লাসরুমেই প্রবেশ করে এবং ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে যায়।

রাষ্ট্রচিন্তাবিদ প্লেটো-র মতে, শৈশবকালীন খেলা হচ্ছে পরবর্তী জীবনের জ্ঞানের ভিত্তি। শিশুর বিকাশের জন্য খেলা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিডনি স্মিথ বলেছেন, অনুকরণ, অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গঠন—এই চারটি মূল প্রক্রিয়ায় আমরা পৃথিবী সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করি, শিশুর খেলা সেই চারটি প্রক্রিয়া নিয়েই গঠিত।

শারীরিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মানসিক, সামাজিক, আবেগ বিকাশেও খেলাধুলার গুরুত্ব অনেক। খেলার মাধ্যমে শিশুর সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি, সামাজিক জ্ঞানবোধ, সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব এবং নেতৃত্বগুণ বিকশিত হয়।